১৭ই এপ্রিল, ২০২৪ খ্রিস্টাব্দ, বুধবার

অসহায় মানুষের পাশে দাঁড়ানো এ সময়ের জরুরি আমল

আপডেট: এপ্রিল ৮, ২০২০

ফয়জুল্লাহ আমান :: আমার ছোট্ট মেয়েটার জন্য ওষুধ কিনতে যাচ্ছি। ঢাকা শহরের পথ ঘাট শূন্য হয়ে আছে। নিঝুমপুরি গ্রামের মত নিরব হয়ে আছে সবখানে। পথের বাঁকের কাছে এক ভদ্রলোক আমাকে সালাম দিলেন। মুখে মাস্ক পরা।

কিছুটা করুণ কণ্ঠে বললেন, ভাই আমার একটা কথা শুনবেন? আমি বললাম, ‘হাঁটতে হাঁটতেই বলুন।’ বলল, না, একটু দাঁড়িয়ে শুনুন।

দাঁড়ালাম। পাঞ্জাবি লুঙ্গি পরা। সামান্য কিছু দাঁড়ি আছে মুখে। গায়ের রং শ্যাম বর্ণ। খেটে খাওয়া সাধারণ ধার্মিক মানুষ। অসহায়ত্বের ছাপ নেই। খুবই স্বাভাবিক বসন।

স্বাভাবিক কণ্ঠেই বললেন, ‘ভাই, আমার চারটে ছেলে মেয়ে। বাসায় আজকের চালটাও নেই। কী যে করি? কাউকে বলতেও পারি না; আপনি যদি একটু সাহায্য করতেন।’ আকুতি মিশ্রিত কণ্ঠ।

‘সামনে আমাদের মসজিদ আছে। আসুন, বলে দিব ইমাম সাহেবকে, আপনাকে সাহায্য করার কথা ঘোষণা করে দিবেন এশার নামাজ বাদে।’ বলেই বুঝতে পারলাম, এ লোক মসজিদে গিয়ে সাহায্য চাইবে এমন নয়।

‘না ভাই, সবার সামনে মুখ দেখাতে পারব না।’ আমতা আমতা করে অসহায়ের মত বললেন, এমনিতে আপনি পারলে কিছু সাহায্য করেন।

ঢাকা শহরে অন্য সময়ে এমন অসংখ্য মানুষ আছে যারা সাহায্য চেয়ে বেড়ায়। প্রথমে এমন ভ্রম হয়েছিল আমার। তাই সহানুভূতি দমিয়ে রেখেছিলাম। স্বাভাবিক দৃষ্টিতে লোকটিকে দেখিনি। তবু তাকে বললাম, ‘সামান্য কিছু দিলে আপনি মন খারাপ করবেন না তো?’

না তা কেন? আপনি যা দিবেন তা-ই হবে।

খুব সামান্য সাহায্যই তাকে করলাম। টাকাটা দিয়ে সামনে বাড়লাম। তার অভাবটা বুঝতে আমার একটু দেরি হয়েছে। হাঁটতে হাঁটতে যখন বুঝতে পারলাম বুকটা দুঃখে ভরে উঠল। পথে বেরিয়েই আজ আমার সামনে সারা দেশের চিত্র যেন ভেসে উঠল।

দুস্থ মানুষের কষ্ট কিছুটা হলেও উপলব্ধি করতে পারলাম এই অন্ধকার নিরব সন্ধ্যায়। ওষুধের দোকানের দিকে এগিয়ে যাচ্ছি। আমার ভেতরটা দুমড়ে মুচড়ে যাচ্ছে। আহা! মানুষের কী কষ্ট! কী কষ্টের ভেতর দিয়ে মানুষ মোকাবেলা করছে দুর্যোগকাল।

মনে হলো, আমার পকেটের সবগুলো টাকা যদি লোকটাকে দিয়ে দিতে পারতাম। খুবই অপরাধী মনে হলো নিজেকে। আসলে আমি কতটুকু করতে পারব? ক’জনকেই আর সাহায্য করতে পারব?

তবু তো আমাকে চেষ্টা করতে হবে। যে আমার কাছে আসল বা আমার সামনে পড়ল যে দুস্থ মানুষটা তাকে অবশ্যই সাহায্য করা উচিত।

একটি হাদিসে কুদসির কথা স্মরণ হচ্ছে এ মুহূর্তে। নবীজী (সা.) বলেন, কাল কেয়ামতে আল্লাহ সুবহানাহু তায়ালা বলবেন, আমি তোমার কাছে খাবার চেয়েছিলাম; তুমি আমাকে খাবার দাওনি। বান্দা বলবে, হে আল্লাহ, আপনি আমার কাছে খাবার ভিক্ষা করবেন কিভাবে আপনি তো বিশ্ববাসীর পালনকর্তা?

আল্লাহ বলবেন, হ্যাঁ আমার এক অভাবী বান্দা তোমার দুয়ারে গিয়েছিল। সে তোমার কাছে খাবার চেয়েছিল। তাকে যদি তুমি তখন খাবার খাওয়াতে তাহলে আমাকেই দেয়া হতো।

আল্লাহ মানুষকে আবারও বলবেন, আমি তোমার কাছে পানি চেয়েছিলাম, তুমি আমাকে পানি পান করাওনি।

মানুষ বলবে, হে আল্লাহ আপনি কবে আমার কাছে পানি চেয়েছেন? আপনি তো রাব্বুল আলামীন, আপনি আমার কাছে কবে পানি প্রার্থনা করলেন?

আল্লাহ বলবেন, হ্যাঁ, আমার অমুক পিপাসার্ত বান্দা তোমার কাছে পানি চেয়েছিল তুমি তাকে পানি দাওনি। তাকে পানি পান করালে আমাকেই তা দেয়া হতো।

এরপর আল্লাহ বলবেন, আমি অসুস্থ হয়ে তোমার কাছে গিয়েছিলাম, তুমি আমার সেবা করোনি। মানুষ অবাক হয়ে বলবে, হে খোদা, আপনি কি করে অসুস্থ হন? আপনি তো বিশ্ববাসীর রব?

আল্লাহ বলবেন, হ্যাঁ, একজন অসুস্থ মানুষ তোমার কাছে গিয়েছিল। তুমি যদি তার সেবা করতে তাহলে আমারই সেবা হতো। [মুসলিম শরীফে হযরত আবু হুরাইরা থেকে বর্ণিত]

আল্লাহ সুবহানাহু তায়ালা ইরশাদ করেন, যারা নিজেদের সম্পদ রাতে ও দিনে, গোপনে ও প্রকাশ্যে ব্যয় করে তাদের পুণ্য ফল তাদের পালনকর্তার নিকট রয়েছে, তাদের কোনো ভয় নেই আর তারা দুঃখিতও হবে না। [বাকারা, আয়াত: ২৭৪]

আমরা মনে করি, দরিদ্র মানুষকে সহায়তা করতে হবে সত্য, কিন্তু এসব দান সদকা বড় বিত্তশালী লোকদের কাজ। আমি তো নিজেই খেতে পাই না। আমি কি অন্যকে সাহায্য করব?

নিজের পরিবার পরিজনের নিত্য প্রয়োজন মিটাতে যাদের হিমশিম খেতে হয় তাদের আবার দান সদকা কিসের? আগে তো নিজে বাঁচতে হবে? তারপর অসহায় মানুষের পাশে দাঁড়ানোর চিন্তা করা যাবে।

খুবই দুঃখজনকভাবে এমন ক্ষুদ্র চিন্তা আমাদের সমাজে ছড়িয়ে পড়েছে। অথচ এটা কোনো ইসলামী ভাবনা নয়। ইসলাম তো শেখায় যার সামান্য আছে সে তার সামান্য থেকেই অন্য অভাবীদের সাহায্যার্থে এগিয়ে আসবে। বরং যখন অভাব থাকে তখন আরও বেশি মনোযোগী হতে হবে অন্যকে সাহায্য করায়।

হাদিসে এসেছে, আল্লাহ বান্দার সাহায্য করেন যখন বান্দা তার কোনো ভাইয়ের সাহায্যের চেষ্টা করে। [বুখারী]

দুর্যোগকালে আপনি যদি অন্যের বিপদ দূর করার চেষ্টা করেন আল্লাহ সুবহানাহু তায়ালা আপনার এ সহমর্মীতার কারণে আশা করা যায় দ্রুতই দুর্যোগ থেকে রক্ষা করবেন আপনাকে আপনার পরিবারকে।

নবীজীর সাহাবিরা যখন চরম অভাবে সময় কাটাতেন তখনও অন্যকে সাহায্য করার চিন্তা করতেন। একবার এক সাহাবির ঘরে সামান্য খাবার আছে। তার শিশু সন্তানের জন্যই তোলা ছিল খাবারটুকু। এ সময় এক পথচারী অসহায় মানুষ আসেন।

সাহাবী দম্পতি পরামর্শ করে প্রদীপ নিভিয়ে তার সঙ্গে খেতে বসেন। বাচ্চাকে আগেই ঘুম পাড়িয়ে দেন। অতিথির সঙ্গে খাওয়ার ভান করেন তারা। অতিথি পেট পুরে খেয়ে ঘুমিয়ে পড়ে। সে জানতেও পায় না ঘরের লোকগুলো না খেয়ে আছে।

স্বামী স্ত্রী এবং বাচ্চা না খেয়েই রাত কাটান। সকালে নবীজীর দরবারে যাবার পর শুনতে পান আল্লাহ তাদের বিষয়ে কোরআনের আয়াত নাযিল করেছেন। আল্লাহ সুবহানাহু তায়ালা ইরশাদ করেন, আর তারা নিজেদের উপর অগ্রাধিকার দেয় অন্য দুস্থদের, নিজেরা অভাবগ্রস্ত হলেও। যাদেরকে অন্তরের কার্পণ্য থেকে মুক্ত রাখা হয়েছে তারাই সফলকাম। [সুরা হাশর, আয়াত ৯]

রাসূল (সা.) বলেন, আল্লাহ তায়ালা এই সাহাবী দম্পতির সেবাপরায়নতায় পরম সন্তোষ প্রকাশ করে এ আয়াত নাযিল করেছেন। [বুখারী, ইবন কাসির]

আমাদের মুসলিমদের ভেতর সেই চেতনা ফিরিয়ে আনতে হবে। নিজে অভাবী হওয়া সত্ত্বেও অন্যকে সাহায্য করার মানসিকতা ফিরিয়ে আনতে হবে করোনার এ দুঃসময়ে।

বড় শিল্পপতিরাই দরিদ্রদের অর্থ সহায়তা করবে এমন ভাবনা কোনো মুসলিমের ভাবনা নয়। আল্লাহ ছাড়া সকলেই অভাবি, যে যত ধনীই হোক, অভাব সবারই আছে।

মূলত নবীজীর ভাষ্যমতে মনের বিত্তই প্রকৃত বিত্ত। অন্যের দুঃখ দুর করার জন্য অনেক বড় বিত্তশালী হওয়া লাগে না, লাগে কেবল দুঃখী দরিদ্র মানুষের কষ্টগুলো অনুভব করার মত সুন্দর মন।

আল্লাহ আমাদের সবার ভেতর সংবেদনশীলতা দিয়ে দিন। প্রবল করে দিন আমাদের সহানুভূতির শক্তি।

প্রিয় নবী ও তার সাহাবিদের মত সমাজের সব মানুষের জন্য আল্লাহ আমাদের ভেতর সৃষ্টি করে দেন সহমর্মীতা, দরদ ও ভালোবাসার অনন্য আধ্যাত্মিক গুণ। আমীন।

92 বার নিউজটি শেয়ার হয়েছে
  • ফেইসবুক শেয়ার করুন