২০শে এপ্রিল, ২০২৪ খ্রিস্টাব্দ, শনিবার

ব্যাংকগুলোতে ডলার সংকট,১৫দিনের ব্যবধানে বেড়েছে সাড়ে ৩ টাকা

আপডেট: অক্টোবর ১৯, ২০১৯

বিজয় নিউজ:: আর্থিক খাতে ভারসাম্যহীনতা প্রকট আকার ধারণ করেছে। এ খাতের বিভিন্ন সূচকে অস্থিরতা দেখা দিয়েছে। একটির সঙ্গে অন্যটি মিলছে না। এর ফলে একের পর এক নানা ধরনের সংকট দানা বাঁধছে। একটির সমাধান হতে না হতেই আরেকটি এসে হাজির।

তারল্য সংকট, মাত্রাতিরিক্তি খেলাপি ঋণ, মূলধন ঘাটতি, নাজুক ঋণ আদায় পরিস্থিতি, বৈদেশিক মুদ্রার সংকট, টাকা পাচারের মতো নেতিবাচক পরিস্থিতি মোকাবেলা করে আর্থিক খাত এখনও মেরুদণ্ড সোজা করে দাঁড়াতে পারেনি।

১৮ সেপ্টেম্বর দুর্নীতিবিরোধী অভিযান শুরুর পর অভিযুক্ত বা সন্দেহভাজনদের ব্যাংক হিসাবের তথ্য তল্লাশি করা হচ্ছে। এতে অনেকের ব্যাংক হিসাব থেকে অর্থ তোলা বা স্থানান্তরে অলিখিত নিষেধাজ্ঞা রয়েছে। ফলে অনেকেই টাকা তুলতে পারছেন না। এ পরিস্থিতিতে অনেকের মধ্যে আতঙ্ক দেখা দিয়েছে।

আতঙ্কগ্রস্তরা ব্যাংক থেকে টাকা তুলে নিচ্ছেন। অনেকে নগদ টাকা ব্যাংকে না রেখে বিদেশে পাচার করছেন। এতে করে কার্ব মার্কেটে ডলারের দাম হু হু করে বেড়ে যাচ্ছে। ব্যাংকেও বাড়ছে। ব্যাংক থেকে টাকা তুলে নেয়ায় তারল্য সংকটের আশঙ্কা করা হচ্ছে।

এ প্রসঙ্গে দেশের শীর্ষ স্থানীয় অর্থনীতিবিদরা সতর্ক বাণী উচ্চারণ করে বলেছেন, দুর্নীতিবিরোধী অভিযান চলা ভালো। এটি চালাতে গিয়ে আর্থিক খাত থেকে সন্দেহভাজনদের সম্পদের তথ্য নেয়ার ওপর জোর দেয়া মোটেও উচিত হবে না। বরং গোয়েন্দা মাধ্যমে সম্পদের তথ্য সংগ্রহ করে সেগুলো উদ্ধারে জোর দেয়া উচিত।

আর্থিক খাত থেকে তথ্য নিতে সন্দেহভাজনদের ব্যাংক হিসাবের তল্লাশি চালানো হলে এর নেতিবাচক প্রভাব অনেক গ্রাহকের মধ্যে পড়বে। তখন তারা টাকা রাখবে না। তখন তারল্য সংকট প্রকট হবে।

যেমনটি হয়েছিল ২০০৭ সালে সাবেক তত্ত্বাবধায়ক সরকারের আমলে চলা দুর্নীতিবিরোধী অভিযানের সময়। সে অভিজ্ঞতা থেকে এবারও সতর্ক হওয়ার পরামর্শ দিয়েছেন তারা।

উল্লেখ্য, ওই সময়ে দুর্নীতিবিরোধী অভিযানে সন্দেহভাজনদের ব্যাংক হিসাব জব্দ ও তথ্য তলব ছিল নিয়মিত ঘটনা। এতে কিছু গ্রাহকের মধ্যে আতঙ্ক ছড়িয়ে পড়লে তারা টাকা রাখা যেমন কমিয়ে দেয়, তেমনি জমা টাকাও তুলে নিতে থাকে। এতে আর্থিক খাতে বড় ধরনের তারল্য সংকট দেখা দেয়।

সূত্র জানায়, অভিযানের শুরুতে সন্দেহভাজনদের ব্যাংক হিসাব জব্দ বা তথ্য তলব করার ঘটনা বেশি মাত্রায় ঘটলেও এখন তা কমে এসেছে। বাংলাদেশ আর্থিক গোয়েন্দা ইউনিট (বিএফআইইউ) সিদ্ধান্ত নিয়েছে, তারা সুনির্দিষ্ট কারণ ছাড়া কোনো গ্রাহকের ব্যাংক হিসাবের তথ্য তলব করবে না। প্রচলিত আইনের বাইরে গিয়ে কারও ব্যাংক হিসাব জব্দ করবে না। ফলে এখন হিসাবের তথ্য চাওয়ার প্রবণতাও কমে গেছে।

প্রচলিত নিয়ম অনুযায়ী মানি লন্ডারিং বা সন্ত্রাসে অর্থায়নের কোনো অভিযোগ পেলে বিএফআইইউ সংশ্লিষ্ট গ্রাহকের হিসাবের তথ্য চায়। তারা নিজ ক্ষমতায় কোনো গ্রাহকের হিসাব ৩০ দিন জব্দ করে রাখতে পারে। এর মেয়াদ আরও ছয় মাস তারা বাড়াতে পারে। তবে এর বেশি রাখতে হলে আদালতের অনুমোদন লাগে। এর বাইরে এনবিআর রাজস্ববিষয়ক তদন্তে হিসাবের তথ্য চাইতে ও জব্দ করতে পারে।

দুর্নীতি দমন কমিশন (দুদক) সন্দেহভাজনদের বিষয়ে তদন্তের জন্য হিসাবের তথ্য চাইতে পারে। এছাড়া আদালত তথ্য চাইতে ও জব্দ করতে পারে।

বাংলাদেশ ব্যাংকের প্রতিবেদন থেকে দেখা যায়, চলতি অর্থবছরের জুলাই-আগস্টে আমানত সংগ্রহের চেয়ে ঋণ বিতরণ হয়েছে বেশি। সাধারণত প্রচলিত ব্যাংকগুলো আমানতের ৮৫ শতাংশ এবং ইসলামী ব্যাংকগুলো ৯০ শতাংশ ঋণ বিতরণ করতে পারে। বাকি অর্থ বাংলাদেশ ব্যাংকে বিধিবদ্ধ আমানত হিসাবে জমা রাখতে হয়।

এছাড়া আরও কমপক্ষে দুই থেকে তিন শতাংশ অর্থ নিজেদের কাছে রাখতে হয় নগদ লেনদেনের জন্য। এ হিসাবে ব্যাংকগুলো ৮২ থেকে ৮৭ শতাংশ ঋণ বিতরণ করতে পারে। কিন্তু ব্যাংকগুলো এর চেয়ে বেশি ঋণ বিতরণ করেছে।

ফলে তারল্য সংকট দেখা দিয়েছে। এদিকে, দুর্নীতিবিরোধী অভিযানের ফলে অনেকে টাকা তুলে নিচ্ছে। এতে সামনের দিনগুলোতে তারল্য সংকট আরও বাড়তে পারে বলে সতর্ক বাণী উচ্চারণ করেছেন অর্থনীতিবিদরা।

প্রাপ্ত তথ্যে দেখা গেছে, চলতি অর্থবছরের জুলাই-আগস্টে ঋণ প্রবাহ বেড়েছে দুই দশমিক তিন শতাংশ। একই সময়ে আমানত বেড়েছে এক দশমিক চার শতাংশ। অর্থাৎ আমানতের চেয়ে ঋণ প্রবাহ বেড়েছে এক শতাংশ বেশি। বাস্তবে আমানতের চেয়ে ঋণ বিতরণ কম হওয়ার কথা ছিল।

এর প্রভাবে আর্থিক খাতে নগদ টাকার চাহিদা বেড়েছে। ফলে কলমানি (এক দিনের জন্য এক ব্যাংক বা আর্থিক প্রতিষ্ঠান অন্য ব্যাংক বা আর্থিক প্রতিষ্ঠান থেকে যে ধার নেয়) থেকে ধার করার প্রবণতা বাড়ছে। এতে কলমানির রেট বেড়েছে।

গত বছরের ১৬ অক্টোবর কলমানির রেট ছিল তিন দশমিক ৬৭ শতাংশ। ৩০ সেপ্টেম্বরে এ হার বেড়ে দাঁড়ায় পাঁচ দশমিক দুই শতাংশ। ১৬ অক্টোবর ছিল চার দশমিক ৯৭ শতাংশ। এ সময়ে কলমানি রেট সাধারণত আরও কম থাকে।

কেন্দ্রীয় ব্যাংকের সাবেক গভর্নর ড. সালেহউদ্দিন আহমেদ বলেন, কলমানির হার বাড়লেই বুঝতে হবে আর্থিক তারল্য সংকট হয়েছে। এর কারণেই কলমানি রেট বাড়ে। দীর্ঘ সময় ধরে আর্থিক খাতে তারল্য সংকট রয়েছে। এ সংকট নিরসনে আমানতকারীদের আস্থা ফেরাতে হবে।

কেন্দ্রীয় ব্যাংকের প্রতিবেদন থেকে দেখা যায়, রেমিটেন্স প্রবাহ সামান্য বাড়লেও রফতানি আয় কমে গেছে- যা তারল্য ও বৈদেশিক মুদ্রা ব্যবস্থাপনায় চাপ সৃষ্টি করেছে। গত অর্থবছরের জুলাই-সেপ্টেম্বরে রফতানি আয় বেড়েছিল ১৪ দশমিক ৭৫ শতাংশ।

চলতি অর্থবছরে বাড়ার পরিবর্তে আরও দুই দশমিক ৯৪ শতাংশ কমেছে। গত বছরের সেপ্টেম্বরে রফতানি আয় বেড়েছিল ৫৪ দশমিক ৬৪ শতাংশ। গত সেপ্টেম্বরে সাত দশমিক ৩০ শতাংশ কমেছে। এতে রফতানিকারকদের মধ্যে তারল্যের ঘাটতি দেখা দিয়েছে।

অনুসন্ধানে জানা গেছে, বর্তমানে ব্যাংকগুলোতে ডলারের সংকট বিরাজ করছে। দুর্নীতিবিরোধী অভিযানের ফলে অনেকে টাকা পাচার করছেন। এ কারণে কার্ব মার্কেটে ডলারের দাম ১৫ দিনের ব্যবধানে প্রায় সাড়ে তিন টাকা বেড়ে গেছে।

এ মাসের শুরুর দিকে কার্ব মার্কেটে প্রতি ডলার বিক্রি হতো ৮৪ টাকা করে। এখন তা বিক্রি হচ্ছে সাড়ে ৮৭ টাকা করে। আগে কার্ব মার্কেট ও ব্যাংকে ডলারের দর প্রায় একই ছিল।

এখন ব্যাংক ও কার্ব মার্কেটের ব্যবধান প্রায় সাড়ে তিন টাকা। অর্থাৎ ব্যাংকের চেয়ে সাড়ে তিন টাকা বেশি দরে কার্ব মার্কেটে ডলার বিক্রি হচ্ছে।

এ প্রসঙ্গে সাবেক তত্ত্বাবধায়ক সরকারের উপদেষ্টা ও বিশিষ্ট অর্থনীতিবিদ ড. এবি মির্জ্জা আজিজুল ইসলাম বলেন, যখন অবৈধভাবে ডলার ব্যবহারের প্রবণতা বৃদ্ধি পায় তখন কার্ব মার্কেটে এর চাহিদা বাড়ে। এতে দাম বেড়ে যায়। কার্ব মার্কেটে ডলারের চাহিদা বাড়া মানেই দেশ থেকে অর্থ পাচার হচ্ছে। ব্যাংকের চেয়ে কার্ব মার্কেটে দাম বেশি বেড়ে গেলেই বুঝতে হবে অবৈধ কিছু হচ্ছে। তখন অর্থনৈতিকভাবে এর বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নিতে হবে।

এদিকে, ব্যাংকেও ডলারের দাম বেড়ে গেছে। খোদ বাংলাদেশ ব্যাংক ডলারের দাম বাড়িয়েছে। গত বছরের ১৬ অক্টোবর ডলারের বিপরীতে টাকার বিনিময় হার ছিল ৮৩ টাকা ৮৩ পয়সা। এ বছরের ৩০ জুন পর্যন্ত তা বেড়ে দাঁড়ায় ৮৪ টাকা ৫০ পয়সায়। বাণিজ্যিক ব্যাংকগুলোতে এর দাম আরও বেশি।

একদিকে চাহিদার তুলনায় সরবরাহ কম থাকায় ডলারের দাম বাড়ছে। অন্যদিকে বেড়ে যাচ্ছে বাংলাদেশ ব্যাংকে থাকা বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভের পরিমাণ। বর্তমানে এর পরিমাণ তিন হাজার ২১৭ কোটি ডলার। গত জুনে ছিল তিন হাজার ২৭৮ কোটি ডলার। রিজার্ভের পরিমাণ বেশি থাকলে সাধারণত বৈদেশিক মুদ্রা বাজার স্থিতিশীল থাকে।

109 বার নিউজটি শেয়ার হয়েছে
  • ফেইসবুক শেয়ার করুন