২৪শে এপ্রিল, ২০২৪ খ্রিস্টাব্দ, বুধবার

হতাশায় নিমজ্জিত বরিশাল বিএনপি

আপডেট: জুন ২৮, ২০১৯

উম্মে রুম্মান :
হতাশায় নিমজ্জিত বরিশাল মহানগর বিএনপি। নগর বিএনপির সভাপতি মজিবর রহমান সরোয়ারের একক আধিপত্যে নেতাকর্মীরা ক্ষুব্ধ। দীর্ঘদিন ক্ষমতার বাইরে থাকায় দলের ভবিষ্যৎ নিয়ে হতাশ হয়ে পড়েছেন অনেকে। দলীয় কর্মকাণ্ড থেকে নিজেদের গুটিয়ে নিয়েছেন নগর বিএনপি এবং অঙ্গ ও সহযোগী সংগঠনের অধিকাংশ নেতা। এ পরিস্থিতিতে বিএনপিতে নাজুক অবস্থা বিরাজ করছে। সহসা এ সংকট থেকে উত্তরণের আশাও দেখছেন না নেতাকর্মীরা।
সরোয়ারের দাবি, সরকারের দমনপীড়ন ও মানুষের ভোটাধিকার হরণের কারণে নেতাকর্মীদের মধ্যে রাজনীতির ভবিষ্যৎ নিয়ে হতাশা বিরাজ করছে। এ কারণে অনেকে দলবিমুখ হয়ে পড়েছেন। তবে নগর বিএনপি ও অঙ্গসংগঠনের একাধিক নেতা বলেছেন, সরোয়ার নগর বিএনপির রাজনীতি নিজের হাতের মুঠোয় রেখেছেন। অনুগতদের দিয়ে দল চালান। এ কারণে ক্ষোভ-অভিমানে অনেক নেতা দলীয় কর্মকাণ্ড থেকে দূরে রয়েছেন।
বরিশাল মহানগর বিএনপির ১৭১ সদস্যবিশিষ্ট কমিটি হয় ২০১৩ সালে। ছয় বছরের পুরনো এই কমিটির অধিকাংশ নেতাই এখন দলে নিষ্ফ্ক্রিয়। সহসভাপতি, যুগ্ম ও সহসম্পাদক এবং সাংগঠনিক সম্পাদকের মতো গুরুত্বপূর্ণ পদের নেতারা দল থেকে দূরে আছেন। নগর যুবদলের পূর্ণাঙ্গ কমিটিতেও সরোয়ার অনুসারীদের আধিপত্য। নগর ছাত্রদলের পাঁচ সদস্যের কমিটি ঘোষণা করা হয়েছে প্রায় এক বছর আগে। ওই কমিটি পূর্ণাঙ্গ হয়নি। একই অবস্থা নগর স্বেচ্ছাসেবক দলের। শ্রমিক দলের নগর সভাপতির মৃত্যুর পর কমিটি আর পুনর্গঠন করা হয়নি। নগর মহিলা দলের কমিটি নেই বরিশালে।
এদিকে ২০ দলীয় জোটের শরিক দলগুলোর মধ্যে বরিশালে সাংগঠনিক ভিত্তি আছে শুধু জামায়াতে ইসলামী এবং খেলাফত মজলিশের। জাতীয় নির্বাচনের পর এ দুই দলের সঙ্গে জোটের প্রধান শরিক বিএনপির রাজনৈতিক যোগাযোগ নেই। বলা হচ্ছে, জামায়াতকে এড়িয়ে চলছে স্থানীয় বিএনপি। তবে নগর জামায়াত ও খেলাফত মজলিশের দুই শীর্ষ নেতা দাবি করছেন, ব্যক্তিগত পর্যায়ে তাদের যোগাযোগ আছে। জাতীয় ঐক্যফ্রন্টের শরিক অনেক দলের অস্তিত্ব নেই বরিশালে।
২০১৩ সালে গঠিত বরিশাল মহানগর বিএনপির সাধারণ সম্পাদক অ্যাডভোকেট কামরুল আহসান শাহীনের মৃত্যুর পর প্রায় পাঁচ বছর ধরে ভারপ্রাপ্ত সাধারণ সম্পাদকের দায়িত্ব পালন করছেন ওই কমিটির প্রথম যুগ্ম সাধারণ সম্পাদক জিয়া উদ্দিন সিকদার। নগর বিএনপির সভাপতি সরোয়ার একই সঙ্গে কেন্দ্রেরও যুগ্ম মহাসচিব। মহানগর বিএনপি নিয়ে দৃশ্যমান কোনো বিরোধ না থাকলেও নগর কমিটির প্রায় এক ডজন নেতা দলে নিষ্ক্রিয়। জিয়া উদ্দিনকে ভারপ্রাপ্ত সাধারণ সম্পাদক করায় অনেকে ক্ষুব্ধ। এ ছাড়া কেন্দ্র ও স্থানীয় দুই পদে থাকা সরোয়ারকে নিয়ে নগর বিএনপিতে চাপা ক্ষোভ রয়েছে। তবে সরোয়ার জানান, তিনি নগরের সভাপতির পদ না ছাড়ার কারণ দলীয় চেয়ারপারসনের কাছে ব্যাখ্যা দিয়েছেন।
সরোয়ারের বিরুদ্ধে ক্ষোভ :নগর বিএনপির একাধিক দায়িত্বশীল সূত্র বলেছে, বরিশাল নগর বিএনপি সরোয়ারের কাছে জিম্মি। ১১ জন সহসভাপতির মধ্যে দু-চারজন ছাড়া বাকিরা দলীয় কর্মকাণ্ডে আসেন না। দু’জন যুগ্ম সম্পাদকের মধ্যে সৈয়দ আকবর নিয়মিত দলীয় কর্মসূচিতে আসেন। অন্যজন মীর জাহিদুল কবির দলের কার্যক্রম প্রায় ছেড়ে দিয়েছেন। তিনজন সহ-সম্পাদকের মধ্যে শুধু আনোয়ারুল হক তারিন দলে সক্রিয়। একমাত্র সাংগঠনিক সম্পাদক আলতাফ মাহমুদ সিকদারকে দলের কোনো কর্মসূচিতে দেখা যায় না। দলীয় কর্মসূচিতে অনুপস্থিত থাকেন প্রচার সম্পাদক রফিকুল ইসলাম শাহীন।
নাম প্রকাশ না করার শর্তে একাধিক নেতা বলেছেন, নগর বিএনপি চলে সরোয়ারের ইচ্ছামাফিক। তিনি চাইলে দলীয় কর্মসূচি পালিত হয়, না চাইলে হয় না। নগর বিএনপির সহসম্পাদক আ ন ম সাইফুল আহসান আজিম ক্ষোভ প্রকাশ করে বলেন, ‘সরোয়ারের নেতৃত্ব আমার ভালো লাগে না। তিনি অযোগ্য লোকদের দিয়ে দল চালান। আমাদের মূল্যায়ন করেন না। ২০১৩ সালের সিটি নির্বাচনে আমার বিরুদ্ধে প্রার্থী দিয়েছিলেন তিনি। তাই সরোয়ারের নেতৃত্বে আর রাজনীতি করার মানসিকতা নেই।’ আজিমের মতে, নগর বিএনপিকে বাঁচাতে হলে নেতৃত্বের পরিবর্তন প্রয়োজন।
যুগ্ম সাধারণ সম্পাদক জাহিদুল কবির বলেন, ‘যারা দলে নতুন এসেছেন তাদের অতি মূল্যায়ন দেখে এখন আর দলের কার্যক্রমে যেতে ইচ্ছে করে না। দুর্দিনে নগরের নেতাদের পাশে পাই না। কাজেরও মূল্যায়ন হয় না। তাই এমন সংগঠন করতে আর ভালো লাগে না।’ নগর স্বেচ্ছাসেবক দলের সাবেক আহ্বায়ক হাবিবুর রহমান টিপু আক্ষেপ করে বলেন, ‘৭৮ সালে ছাত্রদলের রাজনীতি করে বিএনপির সঙ্গে যুক্ত হন তিনি। তবে তিনি নগর বিএনপির সাবেক সভাপতি আহসান হাবিব কামালের ঘনিষ্ঠজন হওয়ায় তাকে নগর কমিটিতে রাখা হয়নি। তার মতো অনেক নেতাকে প্রতিপক্ষ মনে করে সরোয়ার তাদের কমিটিতে ঠাঁই দেননি।
দলীয় নেতাদের ক্ষোভ প্রসঙ্গে সরোয়ার বলেন, ‘আমি পছন্দের নেতাদের নিয়ে কমিটি করিনি। উন্মুক্ত কাউন্সিলের মাধ্যমে কমিটি হয়েছে। গত সিটি নির্বাচনে নগর বিএনপির অনেক নেতা কাউন্সিলর নির্বাচিত হতে না পেরে দলীয় কর্মকাণ্ড থেকে নিজেদের গুটিয়ে নিয়েছেন। এটা তাদের হীনমন্যতা।’ তিনি বলেন, ‘বরিশাল মহানগর বিএনপি দেশের যে কোনো মহানগর কমিটির চেয়ে অধিকতর সংগঠিত এবং শক্তিশালী। তবে ক্ষমতাসীন দল রাষ্ট্রযন্ত্রকে ব্যবহার করে এখানে দলীয় কার্যক্রম পরিচালনা করতে দেয় না। আমরা মাঠে নামলেই পুলিশ বাধা দেয়। এমনকি ধর্মীয় অনুষ্ঠান করতে গেলেও পুলিশের অনুমতি নিতে হয়।’ সরোয়ার আরও বলেন, দলের ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যানের নির্দেশনা পেলেই মহানগর বিএনপির কাউন্সিল করা হবে। তখন গণতান্ত্রিকভাবে নতুন কমিটি গঠন করা হলে বিরাজমান জটিলতা আর থাকবে না।

নেতাদের অভিযোগের বিষয়ে নগর বিএনপির ভারপ্রাপ্ত সম্পাদক জিয়া উদ্দিন সিকদার সমকালকে বলেন, মামলা, অসুস্থতাসহ বর্তমান রাজনৈতিক প্রেক্ষাপটের কারণে অনেকেই দলীয় কর্মকাণ্ডে আসেন না। তবে সবার উচিত দলকে শক্তিশালী এবং গতিশীল করার জন্য রাগ-ক্ষোভ ভুলে দলীয় কর্মসূচিতে অংশ নেওয়া।

অঙ্গসংগঠনেও সমস্যা :বরিশাল মহানগর যুবদলের ২৫১ সদস্য বিশিষ্ট পূর্ণাঙ্গ কমিটি গত বছরের নভেম্বরে অনুমোদন দেয় কেন্দ্র। অভিযোগ আছে, প্রথমে অ্যাডভোকেট আখতারুজ্জামান শামীমকে সভাপতি ও মাসুদ হাসান মামুনকে সাধারণ সম্পাদক করে সাত সদস্যের কমিটি ঘোষণা করে কেন্দ্র। ওই সাত সদস্যের মধ্যে একমাত্র সভাপতি শামীম ছাড়া আর সবাই ছিলেন সরোয়ারের অনুসারী। এ কারণে পূর্ণাঙ্গ কমিটিও সরোয়ার অনুসারীদের নিয়ে গঠিত হয়েছে। ফলে নগর যুবদলের কার্যক্রমের গতি নেই। তবে এ অভিযোগ নাকচ করে দিয়ে শামীম বলেন, বরিশাল নগর যুবদলে কোনো বিভক্তি নেই। তারা ঐক্যবদ্ধভাবে দলীয় কর্মসূচি পালন করেন।

গত বছরের ১৯ আগস্ট রেজাউল করিম রনিকে সভাপতি এবং হুমায়ুন কবিরকে সাধারণ সম্পাদক করে নগর ছাত্রদলের পাঁচ সদস্যের কমিটি ঘোষণা করা হলেও এখন পর্যন্ত নগর ছাত্রদলের পূর্ণাঙ্গ কমিটি হয়নি। নগর ছাত্রদলের নতুন কমিটিতে পদ-পদবি দেওয়া নিয়ে সৃষ্ট জটিলতার কারণে পূর্ণাঙ্গ কমিটি হয়নি বলে অভিযোগ আছে। তবে এ অভিযোগ অস্বীকার করে সভাপতি রেজাউল করিম রনি বলেন, নগর ছাত্রদলের পূর্ণাঙ্গ কমিটি প্রস্তুত করা আছে। যেহেতু, কেন্দ্রের নতুন কমিটি হবে এ জন্য বরিশাল নগর ছাত্রদলের কমিটি এখনও অনুমোদনের জন্য দেওয়া হয়নি। নগর কমিটির মতোই অসম্পূর্ণ নগরীর ৩০টি ওয়ার্ড ছাত্রদলের কমিটি। ৩০ ওয়ার্ডের মধ্যে অর্ধেকের বেশি ওয়ার্ডে ছাত্রদলের কমিটি নেই। এমনকি কোনো কলেজেও নেই ছাত্রদলের অস্তিত্ব। একই অবস্থা মহানগর স্বেচ্ছাসেবক দলের। মহানগর স্বেচ্ছাসেবক দলের কমিটি আছে পাঁচ সদস্যের। ওই কমিটির সভাপতি মাহবুবুর রহমান পিন্টু বলেন, ১৭১ সদস্যের কমিটি কেন্দ্রে জমা দেওয়া হলেও অনুমোদন পায়নি। নগরীর কোনো ওয়ার্ডে নেই স্বেচ্ছাসেবক দলের কমিটি। তবে পিন্টু দাবি করেন, ৫টি ওয়ার্ডে তারা কমিটি করেছেন। বাকিগুলো প্রক্রিয়াধীন।

জামায়াত ও খেলাফত মজলিশের ভাষ্য :বরিশাল মহানগর জামায়াতে ইসলামীর সেক্রেটারি অধ্যক্ষ আমিনুল ইসলাম খসরু বলেন, গত জাতীয় নির্বাচনের সময় স্থানীয় বিএনপির সঙ্গে তাদের ঘরোয়া বৈঠক হয়েছিল। তারপর আর রাজনৈতিক কোনো যোগাযোগ হয়নি। বরিশাল সিটি নির্বাচনেও বিএনপির সঙ্গে মাঠে ছিল জামায়াত। তিনি বলেন, কৌশলগত কারণে তারা নগরীতে প্রকাশ্যে কোনো রাজনৈতিক কার্যক্রম চালাচ্ছেন না। তবে দলের অঙ্গসংগঠন ইসলামী ছাত্রশিবির, ছাত্রীসংস্থা এবং শ্রমিক কল্যাণ ফেডারেশনের কার্যক্রম অব্যাহত আছে। প্রতি বছরই কাউন্সিলের মাধ্যমে এসব অঙ্গসংগঠনের নতুন কমিটি করা হয়।

খেলাফত মজলিশের বরিশাল নগর সভাপতি অধ্যাপক একেএম মাহবুব আলম বলেন, নগরে তাদের ২১ সদস্যের কমিটি আছে। এ ছাড়া ২৭টি ওয়ার্ডে আছে পূর্ণাঙ্গ কমিটি। দলের অঙ্গসংগঠন ছাত্র মজলিশ, মহিলা মজলিশ এবং শ্রমিক মজলিশেরও নগর কমিটি আছে। অধ্যাপক মাহবুব বলেন, তারা দলের কর্মকাণ্ড পরিচালনা করেন নিয়মিত। তবে তেমন প্রচার করেন না।

 

107 বার নিউজটি শেয়ার হয়েছে
  • ফেইসবুক শেয়ার করুন