২৭শে এপ্রিল, ২০২৪ খ্রিস্টাব্দ, শনিবার

হারিয়ে যাওয়া উদ্যোগগুলোর পুনরুজ্জীবন চাই

আপডেট: এপ্রিল ৪, ২০২২

আবু তাহের খান।। দ্রব্যমূল্যের মতোই ক্রমেই অসহনীয় হয়ে উঠছে দেশের যানজট পরিস্থিতিও; বিশেষত বড় শহরগুলোতে এবং সবচেয়ে বেশি রাজধানীতে। আর যানজটের নেতিবাচক প্রভাব শুধু মানুষের চলাচলের দুর্ভোগকেই বাড়াচ্ছে না-এর নেতিবাচক প্রভাব পুরো নাগরিক জীবনকেই এলোমেলো ও দুর্বিষহ করে তুলেছে। এরই মধ্যে নিত্যপণ্যের ওপর থেকে আমদানি শুল্ক হ্রাস, টিসিবির মাধ্যমে পণ্য বিক্রি, বাজার পরিধারণ ইত্যাদি কিছু কিছু ব্যবস্থা নিয়ে পণ্যমূল্য নিয়ন্ত্রণের চেষ্টা করা হচ্ছে (যদিও মূল সমাধান এটি নয়-প্রকৃত সমাধানের জন্য প্রয়োজন নীতিকাঠামোর আমূল পরিবর্তন)। কিন্তু যানজট নিয়ন্ত্রণে কী করা হচ্ছে, তা একেবারেই দৃশ্যমান নয়। বিষয়টি নিয়ে সেমিনার, গোলটেবিল বৈঠক ইত্যাদি পর্যায়ে ও বিশেষজ্ঞমহলে আলোচনা হচ্ছে বটে; কিন্তু এর সমাধানে সরাসরি যুক্ত যেসব প্রতিষ্ঠান, তারা এ ব্যাপারে কতটুকু উদ্যমী এবং বিষয়টিকে তারা কতটুকু গুরুত্বের সঙ্গে নিচ্ছেন, তার ওপরই বস্তুত নির্ভর করছে সমস্যার বাস্তব সমাধান। এ সংক্রান্ত ধারণাগত আলোচনা অনেক দীর্ঘ। কিন্তু সে দীর্ঘ আলোচনায় না গিয়ে আশু বাস্তবায়নের জন্য কিছু প্রস্তাব এখানে সরাসরি তুলে ধরা হলো।

স্বাধীনতার অব্যবহিত পর থেকে ১৯৮০-এর দশকের শেষার্ধ পর্যন্ত রাজধানীতে সরকারি দপ্তরগুলোর (ব্যাংক ব্যতীত) সময়সূচি ছিল সকাল সাড়ে ৭টা থেকে কোনো বিরতি ছাড়া বেলা ২টা পর্যন্ত। বয়সি মানুষের অনেকেই এখনো মনে করেন, অফিসের সে সময়সূচি অনেক বেশি উৎপাদনশীল ছিল। এতে দাপ্তরিক সময়ের পাশাপাশি ব্যক্তি-সময়ের সাশ্রয় হওয়ার বিষয়টিও সমীক্ষার ভিত্তিতে প্রমাণিত। তদুপরি এ সূচির আওতায় সংশ্লিষ্ট কর্মীদের দুপুরের খাবার ঘরে ফিরে খাওয়ার সুযোগ থাকায় এ ক্ষেত্রে ব্যয় সাশ্রয়েরও সুযোগ রয়েছে। আর এর সবচেয়ে বড় ইতিবাচক সামাজিক প্রভাব হচ্ছে, এতে করে রাতে আগেভাগে ঘুমানো এবং খুব ভোরে ঘুম থেকে উঠার স্বাস্থ্যকর অভ্যাসটি সহজেই রপ্ত হয়ে যায়। বস্তুত সরকারি দপ্তরের এ সময়সূচি যখন থেকে পরিবর্তন করা হলো, তখন থেকেই এ দেশে বিলম্বে ঘুম থেকে ওঠার বদভ্যাসটি ব্যাপকতা লাভ করে। এমনি প্রেক্ষাপটে চলমান যানজট পরিস্থিতির ভয়াবহতার কথা বিবেচনা করে রাজধানীর সরকারি দপ্তরগুলোর সময়সূচি অবিলম্বে সকাল সাড়ে ৭টা থেকে বিরতিহীনভাবে বেলা ২টা পর্যন্ত নির্ধারণ করা যেতে পারে। তবে ব্যাংকগুলোর বর্তমান সময়সূচি যথারীতি বহাল থাকতে পারে।

ঢাকা উত্তর সিটি করপোরেশনের (ডিএনসিসি) পক্ষ থেকে ইতোমধ্যে মোটরযানের জোড়-বিজোড় নম্বরভিত্তিক বিভাজন অনুযায়ী প্রতি বিকল্প দিবসে গাড়ি চলাচলের উদ্যোগ গ্রহণ করা হয়েছে। একই ব্যবস্থা ঢাকা দক্ষিণ সিটি করপোরেশন (ডিএসসিসি) এলাকাতেও সমানভাবে প্রবর্তনের উদ্যোগ নেওয়া যেতে পারে। ভারতের নয়াদিল্লিসহ পৃথিবীর আরও বহু দেশেই এ ধরনের ব্যবস্থার চর্চা চালু রয়েছে।

সিদ্ধান্ত ছিল এবং অনুমান করি, কাগজে-কলমে এখনো তা বহাল আছে, আন্তঃজেলা রুটের কোনো বাসই রাজধানীর ভেতরে প্রবেশ করতে পারবে না। আর সে সিদ্ধান্তের আলোকেই তখন গুলিস্তান থেকে বাসস্ট্যান্ড সরিয়ে গাবতলী, মহাখালী ও সায়েদাবাদে স্থানান্তর করা হয়েছিল। কিন্তু সংশ্লিষ্ট রাষ্ট্রীয় প্রতিষ্ঠানগুলোর উদাসীনতা ও শিথিল দৃষ্টিভঙ্গির কারণেই এ চমৎকার সিদ্ধান্তটি বর্তমানে ব্যাপকভাবে শিথিল হয়ে পড়েছে। অভিযোগ রয়েছে, এ ব্যাপারে বাস মালিকদের সঙ্গে রাষ্ট্রীয় প্রতিষ্ঠানগুলোর কোনো কোনো মহলের অনৈতিক সম্পর্ক ও যোগসাজশের কারণেই এমনটি হচ্ছে। সে যাই হোক, উল্লেখিত সিদ্ধান্তটি কড়াকড়িভাবে প্রয়োগ করতে পারলে ঢাকা শহরের যানজট অনেকখানি কমে আসবে বলে আশা করা যায়।

ঢাকার ফুটপাতজনিত যানজট সমস্যা যতটা না হকার ও দোকানদারদের দ্বারা সৃষ্ট, তারচেয়ে অনেক বেশি রাজনৈতিক মতলববাজির ফল। এ ফুটপাতগুলোর অধিকাংশই একশ্রেণির রাজনৈতিক কর্মীর চাঁদা সংগ্রহের নেটওয়ার্ক দ্বারা নিয়ন্ত্রিত। ফলে ফুটপাতভিত্তিক রাজনৈতিক চাঁদাবাজি বন্ধ করা না গেলে ফুটপাতে হকার ও দোকানদার বসাজনিত সন্নিহিত সড়কগুলোর যানজট কিছুতেই নিয়ন্ত্রণ করা সম্ভব হবে না। একইভাবে যানজট নিয়ন্ত্রণ সম্ভব হবে না টার্মিনাল ও বাসস্ট্যান্ডগুলোতে চাঁদাবাজি বন্ধ করতে না পারলে। এ ক্ষেত্রে পাড়া-মহল্লার চাঁদাবাজদের ভূমিকাও নিয়ন্ত্রণ করা প্রয়োজন।

ঢাকা ও এর প্রবেশপথগুলোতে দীর্ঘদিন ধরে বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানের যেসব নির্মাণ কাজ চলছে, সেগুলোর জন্য একটি নির্দিষ্ট সময়সীমা বেঁধে দিয়ে দ্রুততম সময়ে অসম্পূর্ণ কাজগুলো সম্পন্ন করা প্রয়োজন। তদুপরি চলমান কাজগুলো শেষ না হওয়া পর্যন্ত যানজট নিয়ন্ত্রণের বৃহত্তর স্বার্থে এখানে একই প্রকৃতির নতুন কাজে হাত না দেওয়াটাই সমীচীন হবে বলে মনে করি।

এ পর্যন্ত উল্লেখিত পুরোনো উদ্যোগগুলোর পাশাপাশি এবার কিছু নতুন প্রস্তাব এখানে তুলে ধরি। দেশে বর্তমানে যে ১০৩টি বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয় রয়েছে, তার প্রায় ৯০ শতাংশ এবং যে ৫৩টি সরকারি বিশ্ববিদ্যালয় রয়েছে, তার প্রায় ৮০ শতাংশই ঢাকা শহরে অবস্থিত, যেগুলোতে বর্তমানে কয়েক লাখ শিক্ষার্থী পড়াশোনা করছে। চলমান যানজটের কথা ভেবে এ বিশ্ববিদ্যালয়গুলোর সময়সূচি সান্ধ্যকালীন করার বিষয়টি গুরুত্বের সঙ্গে বিবেচনা করা যেতে পারে। তবে সে ক্ষেত্রে মূল চ্যালেঞ্জটি হবে নারী শিক্ষার্থীদের নিরাপত্তার বিষয়টি নিশ্চিত করা। ধারণা করা যায়, আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী আন্তরিক হলে সেটি খুবই সম্ভব।

স্নাতকোত্তর পর্যায়ের শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানগুলোর অন্তত ২৫-৩০ শতাংশ ক্লাস অনলাইনে নেওয়ার কথাও ভাবা যেতে পারে; যা যানজট নিরসনে ব্যাপকভাবে সহায়ক হবে। উপরন্তু ফিজিক্যাল ক্লাসের কোনো শিক্ষার্থী যদি স্বেচ্ছায় অনলাইনে ক্লাস করতে চায়, তাহলে তাকেও সে সুবিধা দেওয়া যেতে পারে। এছাড়া ফিজিক্যাল ও অনলাইন উভয় ক্লাসের শিক্ষার্থীদের মৌখিক পরীক্ষাগুলো অনলাইনে নেওয়ার ব্যবস্থা করা যেতে পারে; যা যানজট নিরসনে সহায়ক হবে এবং এতে শিক্ষার প্রকৃত গুণগত মানে তেমন কোনো হেরফের হবে বলে মনে হয় না।

যানজটের কথা ভেবে পণ্য বিক্রির ক্ষেত্রে ডিজিটাল বিপণন ব্যবস্থাকে ব্যাপকভাবে উৎসাহিত করা প্রয়োজন। সে ক্ষেত্রে সাম্প্রতিক সময়ে বেশকিছু অসৎ ডিজিটাল বিপণন কোম্পানি যেসব অনিয়ম ও দুর্নীতির আশ্রয় নিয়েছে, একই ঘটনার যাতে পুনরাবৃত্তি না ঘটে, তজ্জন্য এ ব্যবস্থাকে একটি দৃঢ় ও সুনির্দিষ্ট আইনি কাঠামোর আওতায় নিয়ে আসতে হবে, যেখানে যে কোনো ধরনের অনিয়মের জন্য কঠোর শাস্তির বিধান নিশ্চিত করতে হবে।

দেশের যানজট পরিস্থিতি প্রতিদিনই খারাপ থেকে অধিকতর খারাপের দিকে যাচ্ছে, তাতে করে পুরো ঢাকা শহরই অদূর ভবিষ্যতে এমন স্থবিরতার পর্যায়ে চলে যেতে পারে, শহরটি আর বসবাস যোগ্যতার স্তরে থাকবে কিনা সে বিষয়ে যথেষ্ট সন্দেহ রয়েছে। তদুপরি দেশের অর্থনীতির ওপরও এ যানজট নেতিবাচক প্রভাব ফেলছে। এ অবস্থায় মাননীয় প্রধানমন্ত্রী না বলা পর্যন্ত সংশ্লিষ্টরা কেউ কোনো উদ্যোগ নেবেন না-এমন পরিস্থিতির জন্য অপেক্ষা করার মতো অবস্থা এখন আর হাতে নেই। অতএব সংশ্লিষ্ট রাষ্ট্রীয় প্রতিষ্ঠানগুলো যদি একসঙ্গে বসে এ ক্ষেত্রে সমন্বিত তৎপরতা গ্রহণে এগিয়ে আসেন, তাহলে বিদ্যমান পরিস্থিতি যত খারাপই হোক না কেন, তা থেকে বহুলাংশে বেরিয়ে আসা সম্ভব বলে মনে করি।

আবু তাহের খান : সাবেক পরিচালক, বাংলাদেশ ক্ষুদ্র ও কুটির শিল্প সংস্থা (বিসিক)

573 বার নিউজটি শেয়ার হয়েছে
  • ফেইসবুক শেয়ার করুন