৯ই নভেম্বর, ২০২৫ খ্রিস্টাব্দ, রবিবার

শরীয়তপুরের একবার খালাস, আরেকবার ১৪ বছরের কারাদণ্ড

আপডেট: আগস্ট ১, ২০১৯

শরীয়তপুরের নারী ও শিশু নির্যাতন দমন ট্রাইব্যুনালের বিচারক আ. ছালাম খান। মেয়েকে ধর্ষণ ও অপহরণের অভিযোগে মায়ের করা মামলায় একদিনেই ৭ জন সাক্ষীর সাক্ষ্যগ্রহণ, আসামির জবানবন্দি, উভয়পক্ষের আইনজীবীদের যুক্তিতর্ক উপস্থাপন এবং পরিশেষে রায় দিয়েছেন। রায়ে আসামি তুষার দাস রাজকে ১৪ বছরের সশ্রম কারাদণ্ড দেওয়া হয়। অথচ ১১ মাস আগে এই একই বিচারক আসামিকে মামলা থেকে অব্যাহতি দিয়ে আদেশ দিয়েছিলেন। যে মামলায় একবার অব্যাহতি দিলেন, সেই মামলায় আবার কিভাবে সাজা দিলেন তা নিয়ে প্রশ্ন তোলেন আইনজীবী। আর একদিনের মধ্যে একটি মামলার বিচার সম্পন্ন করায় হাইকোর্ট বিস্ময় প্রকাশ করেছেন।

আদালত বলেছেন, একটি নির্দিষ্ট মামলার ব্যাপারে বিচারক সাহেবের এত উৎসাহ কেন? তার কি স্বার্থ? গত ৬ মাসে তার আদালতের পরিসংখ্যান কি তা দেখা দরকার। আদালত বলেন, তার মতো যদি সারা দেশের বিচারকরা কাজ করতেন তাহলে তো নিম্ন আদালতে মামলার জট থাকতো না।

এদিকে হাইকোর্ট ১৪ বছরের সাজাপ্রাপ্ত তুষার দাস রাজকে জামিন দিয়েছেন। একইসঙ্গে নিম্ন আদালতের করা ২০ হাজার টাকা জরিমানার আদেশ স্থগিত করেছেন।

বিচারপতি এম. ইনায়েতুর রহিম ও বিচারপতি মো. মোস্তাফিজুর রহমানের হাইকোর্ট বেঞ্চ আজ বৃহস্পতিবার আসামির জামিন মঞ্জুর করে আদেশ দেন। আসামিপক্ষে আইনজীবী ছিলেন অ্যাডভোকেট শিশির মোহাম্মদ মনির। রাষ্ট্রপক্ষে আইনজীবী ছিলেন ডেপুটি অ্যাটর্নি জেনারেল সারোয়ার হোসেন বাপ্পী।

আজ শুনানিতে আদালত বলেন, এখানে সমস্যা হলো আসামি দলিত সম্প্রদায়ের। আর মেয়ের বাবা ব্রাহ্মণ সম্প্রদায়ের। এখানে উচু-নিচু জাতের একটি বিষয় আছে। আদালত বলেন, আমাদের সমাজেতো এরকম প্রথা রয়েছে যে এরকম উচু-নিচু অসম বিয়ের ঘটনা ঘটলে সমাজচ্যুতির ভয় থাকে।

আইনজীবী বলেন, আসামি দলিত সম্প্রদায়ের না হলে মামলা ও হয়রানির শিকার হতো না। তিনি বলেন, আমাদের আইনে জাত বা বর্ণ বলে কিছু নেই। আইনের চোখে সবাই সমান। সকলেই মানুষ হিসেবে বিবেচিত।

এসময় আদালত বলেন, যা বাস্তবতা, তা মানতেই হবে। এটা অস্বীকার করার উপায় নেই। এখানে যদি মেয়ের বাবা এই বিয়ে মেনে নেন, তবে যদি তাকে সমাজচ্যুত করা হয়, একঘরে করা হয় তখন কি হবে। সেটাও দেখতে হবে। যদিও আইনে এরকম উচু-নিচু বর্ণে বিয়েতে বাঁধা নেই। একদিকে আইন, আরেকদিকে বাস্তবতা। সবকিছুই বিবেচনা করতে হবে।

মামলার রায় নিয়ে হাইকোর্টের বিস্ময়
মামলায় দেওয়া রায় নিয়ে আদালত বিস্ময় প্রকাশ করে বলেন, বিচারক (শরীয়তপুরের) তার রায়ে বলেছেন, আসামির বিরুদ্ধে ধর্ষণের অভিযোগ প্রমাণিত হয়নি। তারা স্বেচ্ছায় বিয়ে করেছেন। বাচ্চা হয়ে গেছে। এটা বলার পর অপহরণের অভিযোগে সাজা দেন কিভাবে? রায়ে যেভাবে বলা হয়েছে, সেখানেতো অপহরণ হতে পারে না।

আদালত আদেশের ওই দম্পতির সন্তানের বয়স জানতে চান। আদালত বলেন, বাচ্চার বয়স কত? জবাবে আইনজীবী বলেন, আজ বৃহস্পতিবার পর্যন্ত ৮৯ দিন।

মামলার বিবরণ থেকে জানা যায়, ২০১৭ সালে এসএসসি পরীক্ষার্থী ব্রাহ্মণ পরিবারের মেয়ে সুস্মিতা দেবনাথ অদিতি ভালোবাসার টানে দলিত (মেথর) পরিবারের ছেলে এইচএসসি পরীক্ষার্থী তুষার দাস রাজকে বিয়ে করে ২০১৭ সালের ১৫ অক্টোবর। ঢাকার ঢাকেশ্বরী মন্দিরে এই বিয়ে হয়। এর কয়েকদিন পর অদিতির মা বাদি হয়ে রাজের বিরুদ্ধে নিজের মেয়েকে অপহরণ ও ধর্ষণের অভিযোগে মামলা করেন। পুলিশ দুইজনকে (অদিতি ও রাজ) ২৬ অক্টোবর গ্রেপ্তারের পর আদালতে হাজির করে। আদালত রাজকে কারাগারে পাঠায় ও অদিতিকে সেফহোমে পাঠানোর আদেশ দেন। এরপর এ মামলায় পুলিশ তদন্ত শেষে একইবছরের ১৩ অক্টোবর অভিযোগপত্র দাখিল করে। মামলাটি কিশোর অপরাধ দমন ট্রাইব্যুনালে পাঠানো হয়। এই আদালতে অদিতির বয়স নির্ধারণের একটি সনদ দেয় মেডিকেল অফিসার। সেখানে বলা হয়, বয়স ১৮ থেকে ১৯ বছর। যদিও অদিতির এসএসসি পরীক্ষার নিবন্ধন অনুযায়ী ১৫ বছর। মেডিকেল সনদ পাবার পর আদালত ২০১৮ সালের ২৪ জুন এক আদেশে রাজকে জামিন দেয় ও অদিতিকে নিজ জিম্মায় দেয়। একইসঙ্গে মামলাটি নারী ও শিশু নির্যাতন দমন ট্রাইব্যুনালে পাঠিয়ে দেয়। সেই থেকে শশুর রঞ্জিত দাসের বাড়িতেই ওঠে অদিতি। নারী ও শিশু নির্যাতন দমন ট্রাইব্যুনাল ওই বছরের ৫ আগস্ট মামলাটি বিচারের জন্য আমলে নেন। কিন্তু মামলার বাদি অদিতির মা পারুল দেবনাথ কিশোর আদালতের ২৪ জুনের আদেশের বিরুদ্ধে হাইকোর্টে আবেদন করেন। হাইকোর্ট ৭ আগস্ট এক আদেশে কিশোর আদালতের আদেশ স্থগিত করে দেন। এ অবস্থায় রাজ এই আদেশ সংশোধনের জন্য হাইকোর্টে আবেদন করেন। হাইকোর্ট গত বছর ৮ নভেম্বর এক আদেশে রাজকে জামিন দেন এবং অদিতিকে নিজ জিম্মায় থাকার আদেশ দেন। এরপর একই আদালত (হাইকোর্ট) গত ১৬ জানুয়ারি অদিতির বয়স নির্ধারণ করতে শরীয়তপুরের নারী ও শিশু নির্যাতন দমন ট্রাইব্যুনালকে নির্দেশ দেন। কিন্তু নারী ও শিশু নির্যাতন দমন ট্রাইব্যুনালের বিচারক আ. ছালাম খান বয়স নির্ধারণ না করেই আসামির বিরুদ্ধে গত ১০ এপ্রিল অভিযোগ গঠন করেন। এরপর গত ২৩ জুলাই একদিনে ৭ জন সাক্ষীর সাক্ষ্যগ্রহণ করেন। ওইদিনই আসামির (রাজ) জবানবন্দী গ্রহণ করেন। এরপর ওইদিনই দুইপক্ষের আইনজীবীদের যুক্তিতর্ক শোনেন। এর কিছুক্ষণ পর রাজকে ১৪ বছরের কারাদণ্ড, ২০ হাজার টাকা জরিমানা অনাদায়ে আরো এক বছরের কারাদণ্ড দিয়ে রায় দেন। এই রায়ের পর সেদিন রাজকে কারাগারে পাঠানো হয়। এরপর থেকে রাজ কারাগারে রয়েছেন। এ অবস্থায় এই সাজার বিরুদ্ধে হাইকোর্টে আপিল ও জামিন আবেদন করেন তিনি।

রাজের জামিনে অদিতির মুখে হাসি
এদিকে গত ৩ মে অদিতির কোলজুড়ে আসে এক কন্যা সন্তান। তার নাম রাখা হয়েছে তোর্সা দাস কাব্য। রাজ কারাগারে যাবার পর থেকেই এই শিশুকে নিয়ে হাইকোর্টের বারান্দায় ঘরতে থাকেন স্বামীর জামিনের জন্য। অবশেষে আজ জামিন দিয়েছেন হাইকোর্ট। আর এই জামিন আদেশের পর তার মুখে ফেরে হাসি। যদিও চোখে ছিল পানি। সুখের খবরে এই পানি বলে জানান অদিতি।

তিনি তার বাবা-মাকে উদ্দেশ্য করে বলেন, অনেক হয়েছে। আর আমাদের হয়রানি করো না। আমি তোমাদের সন্তান। আমি ভুল করতেই পারি। আমি ভালোবেসে একজন মানুষকে বিয়ে করেছি। সে কোন সম্প্রদায়ের তা আমার দেখার দরকার নেই। সে একজন মানুষ। তাই তোমরাও আমার স্বামীকে একজন মানুষ হিসেবে মেনে নাও। আর না নিলে আমার আর কিছু বলার নেই।

161 বার নিউজটি শেয়ার হয়েছে
  • ফেইসবুক শেয়ার করুন