আপডেট: অক্টোবর ১৪, ২০২৪
বিশেষ প্রতিবেদক ঃঃ প্রচেষ্টা, দৃঢ় মনবল আর সততাই পারে একটি প্রতিষ্ঠানকে সারা বিশ্বেও মাঝে মাথা তুলে দাড় করাতে। এমনটাই দেখাচ্ছে বাংলাদেশের সবচেয়ে অবহেলিত বরিশালে প্রতিষ্ঠিত ফরচুন সু কোম্পানী। ইতোমধ্যে এই প্রতিষ্ঠানটি এশিয়ার সেরা ২০০ প্রতিষ্ঠানের তালিকায় জায়গা করে নিয়েছে। যুক্তরাষ্ট্রের ব্যবসা-বাণিজ্যবিষয়ক সাময়িকী ফোর্বসে এ তথ্য উঠে এসেছে। সম্পূর্ণ রপ্তানমুখী এ প্রতিষ্ঠানটি বর্তমানে স্পেন, জার্মানী, ভারত, ইতালী, পোল্যান্ড, যুক্তরাষ্ট্রসহ পশ্চিমা দেশগুলোতে তাদের উৎপাদিত পণ্য রপ্তানী করছে। পাশাপাশি এ অঞ্চলের অবহেলিত নারী ও বেকার যুবকদের কর্মসংস্থানে সুযোগ সৃষ্টি করে দিয়েছে। ইতোমধ্যে কোম্পানীর চেয়ারম্যান ২০১৮ সালে দেশে শ্রেষ্ঠ তরুন শিল্পোদ্যোক্তা হিসেবে পুরস্কার পেয়েছেন। ২০২০ সালে যুক্তরাষ্ট্রের বিজনেস ম্যাগাজিন ফোর্বসের ‘এশিয়ার সেরা ২০০ আন্ডার এ বিলিয়ন’ প্রতিষ্ঠানের তালিকায় দেশের শীর্ষ তিন প্রতিষ্ঠানের মধ্যে বরিশালের ফরচুন স্যুজ এর নাম এসেছে। অন্য দুই প্রতিষ্ঠান হলো স্কয়ার ফার্মাসিউটিক্যালস ও রেনাটা ফার্মাসিউটিক্যাল। এছাড়া ২০২১ সালে বঙ্গবন্ধু শিল্প পুরস্কারে ১ম স্থান অর্জন করেছে “ফরচুন গ্রুপ অব কোম্পানী লিমিটেড”। ফরচুনের জুতা রপ্তানি হচ্ছে ইউরোপ, আমেরিকাসহ বিশ্বের বিভিন্ন দেশে। তাদের বার্ষিক লেনদেনের পরিমাণ ৮০০ কোটি টাকার বেশি।
উরচুন গ্রুপ অব কোম্পানী লিমিটেড সূত্রে জানা গেছে, ২০১০ সালের ১৪ মার্চ বরিশাল শিল্প নগরীতে প্রতিষ্ঠিত হয় “ফরচুন সুজ লিমিটেড” নামের প্রাইভেট কোম্পানীটি। মাত্র ৪৭২ জন জনবল নিয়ে জুতা তৈরীর কারখানাটি চালু হয় ২০১১ সালের ৭ সেপ্টেম্বর। অনুন্নত যোগাযোগ ব্যবস্থা আর দক্ষ শ্রমিকের অভাব থাকলেও ধীরে ধীরে এগিয়ে চলা প্রতিষ্ঠানটির উৎপাদিত পণ্য পশ্চিমা দেশগুলোতে বেশ জনপ্রিয় হয়ে ওঠে। যার ধারাবাহিকতায় সম্পূর্ণ রপ্তানী নির্ভর এ প্রতিষ্ঠানটি ২০১৫ সালের ১৪ জানুয়ারী পাবলিক লিমিটেড কোম্পানীতে রূপান্তর করা হয়। বর্তমানে “ফরচুন গ্রুপ অব কোম্পানী লিমিটেড” এর আরও চারটি প্রোডাকশন লাইন (প্রিমিয়ার ফটওয়্যার লিঃ, এম.জে ইন্ডাষ্ট্রিজ, ইউনিওয়ার্ল্ড ফুটওয়্যার এন্ড টেকনোলোজি লিঃ এবং ফেন-এন ফুটওয়্যার লিঃ) সংযুক্ত করে এখন ৫টি কারখানায় বরিশালে তাদের পণ্য উৎপাদন করছে। প্রায় ১০ বছর হতে চললো, চ্যালেঞ্জ মোকাবিলা করে দেশের গন্ডি পেরিয়ে এখন ইউরোপের বাজারে বেশ চাহিদা করে নিয়েছে প্রতিষ্ঠানটির উৎপাদিত পণ্য। স্পেন, জার্মানী, ভারত, ইতালী, পোল্যান্ড, যুক্তরাষ্ট্রসহ পশ্চিমা দেশগুলোতে ফরচুন এর উৎপাদিত পণ্য রপ্তানী করায় একদিকে যেমন দেশে বৈদেশিক মুদ্রা আসছে, অন্যদিকে স্বাবলম্বী হচ্ছেন বরিশাল অঞ্চলের অবহেলিত-নির্যাতিত নারীরা। এখানে কর্মরত সাড়ে ৪ হাজার শ্রমিকের মধ্যে ৮০ ভাগই নারী। ফরচুন সুজ বর্তমানে তাদের ৯টি উৎপাদন লাইনে প্রতিদিন সাড়ে ৩৫ হাজার জুতা তৈরি করছে। চলতি অর্থবছরে কোম্পানিটির রাজস্ব ১৮ শতাংশ বৃদ্ধি পেয়ে ১ হাজার ৪৪০ কোটি ৪০ লাখ টাকা হয়েছে। এছাড়া ১০৯ শতাংশ বেড়ে কর পরবর্তী নিট মুনাফা হয়েছে ২৪ কোটি ৫৫ লাখ টাকা।
ফরচুন গ্রুপ অব কোম্পানীর প্রধান নির্বাহী কর্মকর্তা মোহম্মদ রেদওয়ান বলেন, তাদের কোম্পানীর তৈরী জুতার আকৃতি, গঠন ও গুণগত মান দেশের অন্য যে কোন ব্র্যান্ডের জুতার চেয়ে উন্নত। ফরচুন পণ্য তৈরিতে ক্রেতা সন্তুষ্টির বিষয়ে কখনোই কোনো আপস করে না। ফরচুন বিশ্বের বিখ্যাত ব্রান্ডের জন্য স্যু’জ তৈরি করে থাকে। এর মধ্যে উওঊঈঐগঅঘঘ, ঋওখঅ, ঝখঅতঊঘএঊজ, ঈঈঈ, এঊগঙ, গঅজকঊখ, টগইজঙ, অওজঘঊঝঝ, ঝঞঊঠঊ গঅউউঊঘ, ঊটজঙ ঝঐঙঊঝ, উটঘখঙচ, জঊউঞঅচঊ, খওউখ, ইঙঘউ ঝঞজঊঊঞ, ঈঙজঞওঘঅএবংচজওগঅজক ব্র্যান্ডের জুতা তৈরি হচ্ছে ফরচুনের কারখানায়। ফরচুন আন্তর্জাতিক পরিমন্ডলে রফতানির জন্য নারী, পুরুষ, ও শিশুদের জন্য বিভিন্ন স্টাইলের স্যু’জ, ফ্যশন্যাবল স্যু’জ ও স্পোর্টস স্যুজ উৎপাদন করে থাকে। নিজস্ব ল্যাব সেকশনের মাধ্যমে পরীক্ষা নিরীক্ষা করে এ জুতাগুলো বর্হিবিশ্বে রপ্তানী করা হয়। প্রতিষ্ঠানটির মার্কেটিং ব্যবস্থাকে আরো বিস্তৃত করতে চীনের গুংঝুয়ান শহরে রয়েছে একটি কার্যালয়। সেখান থেকেই পুরো ইউরোপে এই প্রতিষ্ঠানের পণ্য সরবরাহ ও বিক্রি করা হচ্ছে।
এদিকে রাষ্ট্রায়ত্ত দুটি পাটকলের জমি ইজারা পেয়েছে ফরচুন সুজ। ৫৬ একর আয়তনের এই জমিতে ফরচুন জুটেক্স নামে নতুন প্রতিষ্ঠান গড়ে তুলবে পুঁজিবাজারে তালিকাভুক্ত এই কোম্পানি। এই কারখানায় দেশ ও বিদেশের বাজারে সম্ভাবনাময় পাটজাত পণ্য উৎপাদন করা হবে। চলতি বছরের শুরুর দিকে চট্টগ্রাম ও খুলনা জোনে রাষ্ট্রায়ত্ত ১৩টি পাটকল বেসরকারি খাতে ইজারা দেওয়ার জন্য একটি আন্তর্জাতিক দরপত্র ডেকেছিল বাংলাদেশ পাটকল করপোরেশন বিজেএমসি। ওই দরপত্রে অংশ নেয় পুঁজিবাজারে তালিকাভুক্ত দুটিসহ মোট ১৮টি দেশি-বিদেশি সংস্থা ও প্রতিষ্ঠান। সর্বশেষ গত ২৫ মে চূড়ান্ত প্রস্তাব জমা দেয় কোম্পানিগুলো। এর মধ্যে ফরচুন সুজ খুলনা জোনে প্লাটিনাম জুবিলি জুট মিলস ও দৌলতপুর জুট মিলস ইজারা পেতে প্রস্তাব দিয়েছিল। বিজেএমসির মূল্যায়ন কমিটি চূড়ান্ত প্রস্তাব জমা দেওয়া কোম্পানিগুলোর মধ্যে বিজয়ী প্রতিষ্ঠানগুলোকে সরকারি মালিকানাধীন পাটকল ইজারা দেওয়ার জন্য চুড়ান্ত করে। এদের মধ্যে ফরচুন সুজ দেওয়া হয় ৫৬ একর জমি।
পাট খাতে বিনিয়োগের চিন্তা থেকে ফরচুন সুজ সরকারি জমির ইজারায় অংশ নেয় জানিয়ে কোম্পানিটির সেক্রেটারি রিয়াজউদ্দিন ভূইয়া বলেন, ‘গ্রুপ ম্যানেজমেন্ট নতুন কোম্পানির মাধ্যমে পাট খাতে বিনিয়োগের সিদ্ধান্ত হয়েছে। তবে অল্প সময়ে নতুন কোম্পানি খোলা সম্ভব নয় বিধায় ফরচুন সুজের নামে দরপত্র জমা দেওয়া হয়েছিল।
প্রতিষ্ঠানটির চেয়ারম্যান মিজানুর রহমান জানিয়েছেন, বরিশাল কেন্দ্রিক এ প্রতিষ্ঠানের কারখানা রয়েছে দেশের বিভিন্ন জেলায়। পদ্মা সেতুর দ্বার খুলে যাওয়ায় বরিশাল অঞ্চলের ব্যবসা-বাণিজ্যে কী ধরনের পরিবর্তন আসছে, তা বলা যাচ্ছে না। এত দিন আমাদের পণ্যবাহী ট্রাকগুলো চট্টগ্রাম বন্দরে নেওয়ার সময় বিভিন্ন ফেরিঘাটে অনেক সময় দিনের পর দিন আটকে থাকত। এ কারণে অনেক সময় আমাদের শিপমেন্ট বাতিল করতে হয়েছে। এতে আর্থিকভাবে লোকসানের মুখে পড়েছি। কিন্তু পদ্মা সেতু উদ্বোধনের পর বেশ সুবিধা হচ্ছে আমাদের। পাশাপাশি সেই ভোগান্তি এখন লাঘব হয়েছে। আশা করছি শিপমেন্ট বাতিলের মতো পরিস্থিতিতে আর পড়তে হবে না আমাদের। তিনি বলেন, আমরা পদ্মা সেতুর কারণে ব্যবসা সম্প্রসারণের কাজ শুরু করে দিয়েছি। ঝালকাঠির বিসিক শিল্পনগরে আমরা তিন একর জমি নিয়েছি। আরও জমির জন্য আবেদন করেছি। সেখানে ফরচুন টেকনোলজি নামের একটি নতুন প্রযুক্তি কোম্পানি স্থাপনের কাজ চলছে। এ ছাড়া বাকেরগঞ্জে আরও একটি ইউনিট এবং পটুয়াখালীতে একটি বড় জমি অধিগ্রহণের প্রক্রিয়া চলছে। সেখানে আমরা কৃষিনির্ভর শিল্প গড়ে তোলার উদ্যোগ নিয়েছি।
মিজানুর রহমান বলেন, পদ্মা সেতু আমাদের জন্য আশীর্বাদস্বরূপ। কারণ, এতে আমাদের দুই থেকে পাঁচ দিন সময় বাঁচবে। যোগাযোগ ব্যবস্থা খারাপ থাকায় আগে আমাদের প্রচুর ক্ষতিপূরণ দিতে হতো। এখন আর সেটা হবে না। এখন ভাঙ্গা থেকে কুয়াকাটা পর্যন্ত সড়ক চার লেনে দ্রুত উন্নীত করার উদ্যোগ নিতে হবে। পাশাপাশি আয়কর বিভাগ, রপ্তানি উন্নয়ন ব্যুরো, বিদ্যুৎ এবং অন্যান্য রপ্তান্তি সংশ্লিষ্ট কার্যালয়ের কর্মকান্ড বা শাখা বরিশালেও স্থাপন করতে হবে, যাতে বরিশাল থেকে পণ্য রপ্তানি করতে ঢাকায় যেতে না হয়। আর ভোলায় গ্যাস আছে। বরিশালে গ্যাস আসার বিষয়টি নির্ভর করছে ভোলা সেতু নির্মাণের ওপর।
তিনি এক প্রশ্নের জবাবে বলেন, শুধু আমি কিংবা আমার প্রতিষ্ঠান নয়, দেশ ও দেশের জনগণকে নিয়ে এগিয়ে যেতে হবে। সে লক্ষ্যে ভবিষ্যতে দেশের বিভাগীয় শহরগুলোতে “ফরচুন” ব্র্যান্ডের জুতা বাজারজাত করণের পরিকল্পনা রয়েছে আমাদের। মিজানুর রহমান জানান, তার জন্মস্থান বরিশাল হওয়ায় বন্দরনগরী চট্টগ্রামে পর্যাপ্ত সুযোগ-সুবিধা থাকা সত্ত্বেও বরিশাল বিসিক শিল্প নগরীতে কারখানা স্থাপন করেছেন তিনি। অবহেলিত এ অঞ্চলের মানুষের জন্য কর্মসংস্থান তৈরি করতেই নানা প্রতিবন্ধকতা থাকা সত্ত্বেও তিনি বরিশালেই কারখানা গড়ে তুলেছেন।
আরো এক প্রশ্নের জবাবে মিজানুর রহমান বলেন, বাবা ছোটখাটো চাকরি করতেন। তিনি যে বেতন পেতেন, তাতে সংসারে অভাব-অনটন লেগেই থাকত। তাই চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়ার সময় টিউশনি করেই নিজের খরচ চালাতাম। তবে বাবা মারা যাওয়ার পর পুরো সংসারের দায়িত্ব আমার কাঁধে এসে পড়ে। তখন বিভিন্ন যন্ত্রপাতি আমদানি শুরু করি। তখন কিছু টাকাপয়সা হয়েছিল। সেই টাকা দিয়েই ছোট ছোট কারখানা করি। তারপরে জুতা উৎপাদন শুরু করি। এ ক্ষেত্রে চীনের সরবরাহকারীরা অনেক সহযোগিতা করেছেন। ২০০৪ সালে মিজানুর রহমান এমব্রয়ডারি কারখানা করেন। ভালোই ক্রয়াদেশ পাচ্ছিলেন। দুই বছর পর করেন কার্টন ও বক্স কারখানা। এগুলো ছিল ছোট উদ্যোগ। ২০০৮ সালে জুতার কারখানার চাকরিটা ছেড়ে দিলেন। ওই বছরই চট্টগ্রাম ইপিজেডে কোরিয়ান একটি প্রতিষ্ঠানের সঙ্গে যৌথভাবে জুতার কারখানা করলেন। তবে সেটা বছর দেড়েকের বেশি টেকেনি। তবে মিজানুরের হাতে তখন প্রচুর ক্রয়াদেশ। অন্য প্রতিষ্ঠানের মাধ্যমে সেসব ক্রয়াদেশের পণ্য তৈরি করে রপ্তানি করলেন। ওই সময়ই মিজানুর রহমান সিদ্ধান্ত নেন, একক মালিকানায় জুতার কারখানা করবেন এবং সেটা নিজের জন্মস্থান বরিশালে। যেই ভাবা, সেই কাজ। ২০১০ সালে চট্টগ্রাম থেকে বরিশালে এসে বরিশালে আসেন। বিসিকে জমি বরাদ্দ নিয়ে ২০১২ সালে ফরচুন শুজের কারখানা স্থাপন করেন মিজানুর রহমান। শুরুতে কর্মী ছিলেন মাত্র ৪৭২ জন, যা বেড়ে বর্তমানে সাড়ে সাত হাজার হয়েছে।
এদিকে বাংলাদেশ বিশ্বের ৫০ রফতানি কারক দেশের একটি। এটা রফতানিতে একটি মাইল ফলক। দখিন বঙ্গথেকে এর অংশিদার হতে পেরে নিযেকে সৌভাগ্যবান হিসেবে উল্লেখ করেন ফরচুন গ্রুপের চেয়ারম্যান মিজানুর রহমান। তিনি বলেন, দক্ষিন এশিয়ায় আজ ভারতের পরেই রফতানি ৫০ বিলিয়ন ডরার অতিক্রম করা আমাদের একটি মাইল ফলক। আশা করছি শিগ্রই আমরা রফতানি কারক হিসেবে হাই প্রডাক্ট রফতানি করে ভারতকেও পেছনে ফেলতে সক্ষম হবো। ###