২০শে এপ্রিল, ২০২৪ খ্রিস্টাব্দ, শনিবার

শামসুর রাহমানের কবিতা: ব্যক্তিগত ও নৈর্ব্যক্তিক প্রসঙ্গ

আপডেট: আগস্ট ১৯, ২০১৯

আধুনিক বাংলা কবিতায় রাজনৈতিক ধারা বেশ জোরালো। অন্তত বাঙালির জীবনে যতদিন, অন্যান্য বিষয়ের চেয়ে রাজনীতিকে বেশি গুরুত্ব দেওয়া হবে, অন্য যেকোনো পেশাজীবীর চেয়ে রাজনীতিবিদদের মানুষ বেশি সমীহ করবে, ততদিন রাজনৈতিক ধারার কবিতার গুরুত্ব থাকবে। বাঙালির জাতীয় জীবনে যেকোনো অধিকার আদায়ের পথ হিসেবে যতদিন রাজপথে আন্দোলন হবে, ততদিন স্লোগানের মূল্য থাকবে। আর কবিরাও গণমানুষের অধিকার আদায়ের কথা বলতে গিয়ে, কবিতার পঙক্তিকে স্লোগানের আদলে রচনা করবেন। রবীন্দ্র-উত্তর বাংলা কবিতায় প্রথম বলিষ্ঠকণ্ঠ কাজী নজরুল ইসলাম। ব্রিটিশবিরোধী আন্দোলনে তাঁর কবিতা জাতিকে দ্রোহের রসদ জুগিয়েছে। এরপর জাতীয় জীবনে নানা-সংকটে-সংগ্রামেও তাঁর কবিতা বাঙালির কণ্ঠে উঠে এসেছে। এরপর সুভাষ-সুকান্তও রাজনৈতিক ধারার কবিতা রচনায় ব্রতী হয়েছেন। অর্থাৎ এই কবিরা শিল্পচর্চার পাশাপাশি জনগণের সঙ্গেও নানা সময়ে সামিল হয়েছেন। বিশেষত জাতীয় সংকটমুহূর্তে তাঁরা কবিতা লিখে বিশেষ ভূমিকা পালন করেছেন। রাজনীতিসচেতন কবিদের তালিকায় শামসুর রাহমানের নামও স্বাভাবিকভাবে উচ্চারিত হবে। কারণ, তাঁর কবিতার একটি বিশেষ ও বিপুল অংশ জনসম্পৃক্ত। একই সঙ্গে তাঁর কবিতার অনুষঙ্গগুলো যতটা ব্যক্তিগত, ততটাই হয়ে উঠেছে নৈর্ব্যক্তিক।

রবীন্দ্র-উত্তর বাংলা কবিতায় জীবনানন্দ দাশ, সুধীন্দ্রনাথ দত্ত, বিষ্ণু দে, বুদ্ধদেব বসু প্রমুখের কবিতায় রাজনৈতিক চেতনার চেয়ে সামাজিক জীবন, ব্যক্তিগত জীবনাচারের চিত্রায়ণ বেশি গুরুত্ব পেয়েছে। যদিও ওই সময়ে কাজী নজরুল ইসলাম এবং অব্যবহিত পরবর্তী সময়েই সুভাষ-সুকান্ত রাজনৈতিক বিষয়কে কবিতায় তুলে আনা শুরু করেছিলেন। তবে, সময়টা পরাধীনতার, স্বাধিকার আন্দোলনের। এরপর ৪৭-এর দেশ ভাগের পর থেকে বাংলাদেশের (তৎকালীন পূর্ব পাকিস্তান) রাজনীতিতে নতুন মোড় নেয়। ওই সময় প্রথমে রাষ্ট্রভাষাকে কেন্দ্র করে আন্দোলন, রক্তপাত; এরপর ৬৯-এর গণআন্দোলন এবং সবচেয়ে মহান মুক্তিযুদ্ধ ওই সময়ের কবিদের করে তুলেছে তীব্রভাবে রাজনীতি সচেতন। একইসঙ্গে করে তুলেছে গণমানুষের বন্ধুও। শামসুর রাহমানের প্রস্তুতি, প্রকাশ-বিকাশও ওই সময়টাতেই। সময় তাঁকে দিয়ে লিখে নিয়েছে বেশ কিছু রাজনৈতিক কবিতা। ওই কবিতাগুলোর রাজনৈতিক গুরুত্ব যেমন আছে, তেমনি আছে সামাজিক তাৎপর্য, উপস্থিতকালে সংঘটিত ঘটনার সংবাদমূল্য; পরন্তু শিল্পমূল্যও।

শামসুর রাহমান জানতেন, কিভাবে দিনানুদিনের ঘটনাকেও কবিতা করে তুলতে হয়। তাই তিনি কবিতার ভাষাকে করে তুলেছেন শিক্ষিত বাঙালির মুখের ভাষার কাছাকাছি। এমনকি কখনো কখনো স্থানীয় ঢাকাবাসীর মুখের ভাষাও। তবে, প্রতিদিনের ঘটনার ভেতর থেকেও তিনি কবিতার রসদ কুড়িয়ে এনেছেন। খুব তুচ্ছ কিন্তু মর্মস্পর্শী অনেক বিষয়কে এমনভাবে উপস্থাপন করেছেন, তাতে পাঠকের মর্মমূল ছুঁয়ে গেছে। তবে দিনানুদিনের ঘটনাপুঞ্জকে, কেবল বিবৃতির মতোই তিনি বর্ণনা করেননি, তাকে করে তুলেছেন স্মরণীয়ও। এর জন্য শব্দ নির্বাচন, গঠন ও অলঙ্কার প্রয়োগে মননশীলতার পরিচয় দিয়েছেন তিনি। এরপরও বড়সত্য— শামসুর রাহমানের কিছু কিছু কবিতা যতটা শিল্পরুচির পক্ষে, তারও বেশি গণরুচির পক্ষে। তাঁর অধিকাংশ কবিতাই জনমুখী, সমাজে সংঘটিত ঘটনাপুঞ্জের তাৎক্ষণিক প্রতিক্রিয়াসঞ্জাত। এ দিক থেকে দেখলে, বলতেই হয়— শামসুর রাহমানের কবিতার জন্য সময়ই একটি বিরাট পটভূমি তৈরি করে দিয়েছে। তিনি ওই পটভূমিতে নিজের কল্পনা ও মনীষার চাষ করেছেন। ফলিয়েছেন সুপরিপুষ্ট ফসল। এ কারণেই তাঁর কবিতা সমকালেই আদৃত হয়েছে অন্য অনেক কবির চেয়ে বেশি পরিমাণে। এমনকি কিছু কিছু কবিতা কালের দাবি মিটিয়ে হয়ে উঠেছে চিরকালীনও।

জাতীয় ও আন্তর্জাতিক বিষয়াবলির পাশাপাশি ব্যক্তির একান্ত বিষয়ও তাঁর কবিতায় উঠে এসেছে। ব্যক্তি সুখ-দুঃখ বিষয়ে আপেক্ষিক চিন্তা করে, কিন্তু এই দুয়ের কারণ প্রায়-ই তার অজানা। কেউ-কেউ কেবল সুখের প্রত্যাশা করেন, দুঃখের অনিবার্য বাস্তবতাকেও স্বীকার করতে চান না। জীবনে দুঃখ এসে পড়লে হতাশায় নিমজ্জিত হন। প্রায়-ই নৈরাশ্যবাদী চিন্তায় আক্রান্ত হন। নিজেকে প্রকৃতির অবহেলার পাত্র মনে করেন। ভাবতে চান না— মানবজীবনে সুখ-দুঃখ পাশাপাশিই চলে। উভয়ের সম্পর্ক সাংঘর্ষিক হলেও অবস্থান প্রায়-ই একই সমতলে। বাঙালি যখন সুখে থাকে, তখন সে বুঝতে পারে না সুখ কী? কিন্তু দুঃখের সময় উপলব্ধি করতে পারে, এর আগে সুখেই ছিল সে। কিছু দুঃখ ব্যক্তির স্বসৃষ্ট, কিছু দুঃখ বিধির লিখন। একদিক থেকে বিবেচনা করলে দেখা যাবে— বাঙালি মূলত দুঃখবিলাসী জাতি। তাই সে ইনিয়ে-বিনিয়ে দুঃখের কথা যত বেশি পারে শোনায়। বিপরীতে সুখের কথা সিকিভাগও প্রকাশ করে না। জাতি হিসেবে দুঃখবিলাসী বলেই হয়তো সে সর্বত্রই দুঃখের দেখা পায়। শামসুর রাহমানের ‘দুঃখ’ কবিতার পঙক্তিতে পঙক্তিতে এই দুঃখের নিপুণ বর্ণনা রয়েছে। রয়েছে অনন্ত বেদনার বিপুল আয়োজন। স্বজাতির মৌলিক সংকট তিনি শনাক্ত করতে পেরেছেন সঠিক সময়ে, নির্ভুল নিয়মে। তাই বর্ণনাও করেছেন হুবহু। বলেছেন—
বিশ্বস্ত মাধুর্যে আর রুক্ষতার সুতীক্ষ্ন সঙ্গীনে
দুর্বিনীত ইচ্ছার ডানায়
আসক্তির কানায়-কানায়
বৈরাগ্যের গৈরিক কৌপীনে
দুঃখ তার লেখে নাম।

ব্যক্তিগত ও পারিবারিক জীবনের পাশাপাশি জাতীয় জীবনেও এই দুঃখের বহুমুখী উপস্থিতি শামসুর রাহমান উপলব্ধি করেছেন। এমনকি বাংলার বর্ণমালার ভেতরও দেখেছেন অনন্ত দুঃখের উপস্থিতি। তাই বর্ণমালার নাম দিয়েছেন, ‘বর্ণমালা, আমার দুঃখিনী বর্ণমালা’।

ভাষা-মুক্তিযুদ্ধ, দেশপ্রেমের মতো তাঁর আরও একটি প্রিয় অনুষঙ্গ মা। এই মাকে নিয়ে তিনি যেমন লিখেছেন, ‘আমার মাকে’। এ কবিতায় তাঁর উপলব্ধি— ‘সোনার কলসে আর সাঁঝ-নামা দিঘির গহনে’ আবহমান বাংলার জননী মাত্র’রই চাওয়া ‘বুকের সুক্ষ্ন সোনালি সুতোয় চিরদিন/ সমস্ত জীবন হোক নক্সীকাঁথা’। সন্তান মাত্রই মাকে সবসময় দুঃখিনী হিসেবে আবিষ্কার করে। পৃথিবীর সবচেয়ে কষ্টসহিষ্ণু নারী মনে হয় আপন মাকে। মা কখনো বাবাকে কোনো কারণে কোনোভাবে কষ্ট দেন কি না, সন্তান সে খবর রাখে না। তাই সন্তান শামসুর রাহমান মায়ের মূর্তি আঁকতে গিয়েও কেবল কর্মব্যস্ত নিভৃতচারিণী মায়ের মূর্তি আঁকেন বার বার। মাকে কখনো আনন্দ করতে দেখেন না সম্মোহিত সন্তান। কবি কেবল দেখেন ‘ধুয়ে মুছে বাসন-কোসন/ সেলাইয়ের কলে ঝুঁকে, আলনায় ঝুলিয়ে কাপড়/ ছেঁড়া শার্টে রিফু কর্মে’ মেতে উঠতে। আবার ‘মা’ কবিতায় ‘এ-বাড়ির গণ্ডি ছাড়া কোথাও পড়ে না তাঁর পায়ের পাতার/ কালো ছাপ’ বলেও মায়ের নিভৃতচারিতার বিষয় স্পষ্ট করে তোলেন।

ক্ষুধার প্রশ্নে মনোদৈহিক নিবেদনের একটি আশ্চর্য সুন্দর ক্ষমাসম্ভব ও ধ্যানসাধ্য আরাধনা আছে তাঁর। একটি কষ্টানুভবসম্ভব চিত্র তার কবিতাকে আচ্ছন্ন করে রাখে। সেখানে নন্দনলোকের একেকটি দরোজার ওপারে অপেক্ষমাণ পাঠকের নান্দীপাঠে একেকটি বিষয় অভিঘাত সৃষ্টি করে। ‘রূপালী স্নান’ কবিতায় এই ক্ষুধার্ত মানুষের আকুতি রয়েছে ঠিকই, সে সঙ্গে তীব্র সৌন্দর্যও চিত্রিত হয়েছে। যে নিঃসঙ্গ ক্ষুধার্ত ‘শুধু দুটুকরো শুকনো রুটির নিরিবিলি ভোজ’-এর আয়োজনকে মানবজীবনের সাফল্য হিসেবে ঘোষণা করতে প্রলুব্ধ, সে সত্তাই জানান দেয়— ‘ঝিঁঝির কোরাসে স্তব্ধ, বিগত রাত মনে করে/ উন্মন-মনে হরিণের মতো দাঁতে ছিঁড়ি ঘাস,/ হাজার যুগের তারার উৎস ঐ যে আকাশ/ তাকে ডেকে আনি হৃদয়ের কাছে…।’

শামসুর রাহমান জীবন ও সংসারকে দেখেছেন সংগ্রামের ভেতর। লড়াইয়ের ভেতর দিয়েই তাঁর জাতিকে টিকে থাকতে দেখেছেন। তাই তাঁর কাছে লড়াই করে টিকে থাকাটাই বীরের জীবন, কিন্তু নতজানু হয়ে নয়। এ জন্য তাঁর আদর্শ চরিত্র ‘চাঁদসদাগর’। চাঁদসদাগরকে দৃঢ়চেতা মানুষের প্রতীকরূপে নতুন করে উপস্থাপন করেন তিনি। এমনকি এই চরিত্রের ভেতর নিজেকেই আবিষ্কার করেন বারবার। বলেন— ‘সত্য চাঁদসদাগর যুবা নয়/ আর, আগেকার উদ্দামতা শিরায় করে না খেলা/ যখন তখন, এখন সে হৃতদীপ্তি, হীনবান/ সেই কবে অস্তমিত মহাজ্ঞান। একটি কি দু’টি/ নয়, ছয় ছ’টি ছেলে কালবিষে হয়ে গেছে নীল,/ আমার সপ্তম পুত্র লখিন্দর, সেও সর্পাঘাতে/ নেউল, ময়ুরময় সুরক্ষিত সাঁতালি পর্বতে/ লোহার বাসর ঘরে কেমন মৃত্যুর মতো স্তব্ধ/ হয়ে গেল’— এমত উচ্চারণেই নিহিত আছে সর্বস্ব হারানো এক সমর নায়কের আত্মমর্যাদাবোধের দৃপ্ত স্বাক্ষর।

আধুনিককালের মানুষ উপস্থিতকালকে অতীতের চেয়ে গুরুত্ব দেয় বেশি। একইসঙ্গে উপস্থিতকালকে ভিত্তি করেই ভবিষ্যতের পথ রচনার স্বপ্ন দেখে। বিষয়টিকে শামসুর রাহমান দুর্গের সঙ্গে তুলনা করেছেন। বলেছেন,
সম্মুখে কাঁপে অমোঘ সর্বনাশ
দিনের ভস্ম পশ্চিমে হয় জড়ো,
অনেক দূরের আকাশের গাঢ় চোখে
রাত্রি পরায় অতল কাজল তার।
এমন নিবিড় স্মৃতি-নির্ভর ক্ষণে
বলি কারও নাম, হৃদয়ের স্বরে বলি।
জ্বলি অনিবার নিজেরই অন্ধকারে।
(নির্জন দুর্গের গাথা)

ছয়মাত্রার মাত্রাবৃত্তে দুটি পূর্ণপর্ব ও একটি অপূর্ণপর্বের সমন্বয়ে রচনা করেছেন, ‘নির্জন দুর্গের গাথা’। আত্মদহন ও আত্মআবিষ্কারকে প্রায় একই সমতলে কল্পনা করেছেন। ‘অনেক দূরের আকাশের গাঢ় চোখে/ রাত্রি পরায় অতল কাজল তার।’ গভীর রাতে তারকারাজিকে গাঢ় চোখ ও চারিদিকের অন্ধকারকে কাজলের সঙ্গে তুলনা করে উপমা-আশ্রয়ী চিত্রকল্প নির্মাণ করেছেন। কিন্তু এই চিত্রকল্প আপাত প্রকৃতিশ্লিষ্ট হলেও বাস্তবে এই চিত্র জীবনের সংকটমুহূর্তকে বর্ণনার। প্রায় একই রকম হৃদয়বৃত্তি ও গাঢ় বেদনার বর্ণনা রয়েছে ‘শনাক্ত-পত্র’ কবিতায়। এই কবিতায় কয়েকজন অবদমিত যুবক নিজেদের মধ্যে কথা বলে। কথা বলে জীবনের অচরিতার্থতার, স্বপ্ন দেখা, স্বপ্নাহতের।
সূর্যোদয় কখনো দেখেনি বলে, তিনটি যুবক
প্রত্যহ একত্র হয়ে ধর্না দেয় সূর্যাস্তের কাছে।
সূর্যের চুলি­তে আমি বহুদিন সেকেছি আত্মাকে
উল্টিয়ে পাল্টিয়ে, ওহে তবু দেখি এখানে-সেখানে
থেকে যায় স্যাঁতসেতে কিছু ভাব।
(শনাক্ত-পত্র)

শনাক্তপত্রে কবি নেবিবাদী ও নৈরাশ্য-আক্রান্ত; তাই শেষে বলেন, ‘প্রাণপণ হেঁকে বলো শূন্যতায় কী-বা আসে যায়!’ এই উক্তিপ্রধান পঙক্তিতে জীবনের প্রতি হেয়ালি প্রকাশ পেলেও অভিজ্ঞতালব্ধ ধারণার ওপর প্রবল তাচ্ছিল্যও প্রকাশিত হয়েছে— একইসঙ্গে তীব্র কাঙ্ক্ষাও। আধুনিক মানুষ সময়কে যতটা বশিভূত করতে পারে, তারও বেশি সময়ের দাবি সে মেটায়। সময়ের অস্থির শাসনে তার মানসও চঞ্চল হয়ে ওঠে। এমনই অভিজ্ঞতার বয়ান রয়েছে ‘আত্মজীবনীর খসড়া’য়। বলেছেন, ‘গলায় রক্ত তুলেও তোমার মুক্তি নেই।’ এ কবিতায় হাহাকার রয়েছে। সেটা না পাওয়ার, বঞ্চনার। দুঃখ ও বেদনার ছবি আঁকতে গিয়েও কবি আঁকেন ‘দুরাশায় আজো জোনাকিজীবন, কখনো তারা/ দূরের শরতে স্মৃতিগন্ধার পাবে কি আলো?/ এ কথা কখনো জানবে না তবু মুত্যু হবে।’ শেষ পঙক্তির ‘এ কথা কখনো জানবে না তবু মৃত্যু হবে’ বলে কবি জীবনের অনিবার্য পরিণতির চিত্র এঁকেছেন। কিন্তু এ চিত্র দার্শনিক প্রত্যয়সঞ্জাত যতটা, ততটাই আধ্যাত্মসংকট সৃষ্ট; একইসঙ্গে যাপিত জীবনের সুখ-দুঃখের তুলনা-প্রতিতুলনারও। ‘জোনাকি জীবন’-এর মতো রূপক-আশ্রয়ী চিত্রকল্প রচনা করে কবি জীবনের ক্ষণস্থায়িত্বের একটি চিরকালীন বয়ান দেন। যা আধ্যাত্মসংকটগ্রস্ত মানুষকে ব্যাকুল করে তোলে। মানুষের চিন্তার স্রোতে ঢেউ জাগায় বঞ্চিত থাকার স্মৃতি, সময়ের তুমুল অপচয়ের। এ সবই প্রকৃত পক্ষে সময়ের স্বাভাবিক প্রভাব।

কিন্তু সময়ের ঘনঘটা ও ব্যক্তির মনোজগত— এ দুয়ের সম্পর্ক প্রায় সাংঘর্ষিক হয়ে থাকে। বিশেষ করে আধুনিক কালের কর্মব্যস্ত মানুষের মনোজগৎ সম্পর্কে এমন বক্তব্য প্রায় যৌক্তিক হতে বাধ্য। কারণ সমাজে সংঘটিত বিভিন্ন ধরনের ঘটনার সংঘর্ষে ব্যক্তির মনোজগৎ অস্থির হয়ে ওঠে। আর তখনই সে অতীতে সংঘটিত বিভিন্ন ঘটনার সঙ্গে উপস্থিতকালের অভিঘাতের সম্পর্ক বিচার করে। নিজের অচরিতার্থ জীবনের কাঙ্ক্ষাগুলো পরবর্তী প্রজন্মের ভেতর পূরণ হওয়ার স্বপ্ন দেখেন। কিন্তু যখনই সেই স্বপ্ন পূরণ হতে শুরু করে, তখনই তার চিন্তাজগতে ক্রমাগত টানাপড়েন শুরু হয়। নিজের উত্তরাধিকারকেও কখনো কখনো প্রতিদ্বন্দ্বী ভাবা শুরু করে সে। বিষয়টি অতীতচারণা ও বর্তমানের ঘটনার ভেতর দিয়ে বর্ণনা করেন শামসুর রাহমান। বলেন,
নব্য যুবা নিত্য বলে শুনি
বোধি-দীপ্ত জীবন-ঘন ভাষা
অবাক হয়ে ভাবেন পিতামহ:
পুরনো ঘরে এ-কার যাওয়া আসা!

মনে কি পড়ে নিঝুম কুয়োতলা,
গাছগাছালি রাস্তা জমকালো,
মস্ত মঠ, দেয়াল, ঘরবাড়ি,
বকুলতলা স্লোগানে চমকালো?
(টানাপড়েন)
দীর্ঘজীবনের ঘাটে ঘাটে যে স্মৃতি মানুষ জমিয়ে রাখে, তার সঙ্গে বর্তমানের ঘটনার সংঘর্ষ ও প্রতিক্রিয়ার বিচার করতে বসে মানুষ। আর তখনই তার অতীত মানসপটে ভেসে ওঠে। ব্যক্তিকে উত্তেজিত করে, কখনো কখনো করে তোলে ক্রুদ্ধ। জীবনের পড়ন্তবেলায়ও যৌবনের স্মৃতি, উদ্দামতা তাকে রাগিয়ে তোলে, রোমাঞ্চিত করে। তাই বেলা শেষের যাত্রীর কণ্ঠে ফোটে— ‘পুরনো ঘরে এ-কার যাওয়া আসা!’ এই উচ্চারণে বিস্ময়, রোমাঞ্চ। উত্তরপুরুষের আচরণ ও অবয়বে নিজেকেই যেন আবিষ্কার করে পূর্বপুরুষ। শামসুর রাহমানের এই আত্ম-পরিচয়ের অন্বেষণ পাঠককে বিমোহিত করে। বিপুলভাবে বিচলিত করে, আত্মপরিচয়সংকটে ভোগা মানুষকে।
একই রকম কিছু পঙক্তি তুলে ধরা হলো—

১ .
জো, তুমি আমাকে চিনবে না। আমি তোমারই মতো
একজন কালো মানুষ গলার সবচেয়ে
উঁচু পর্দায় গাইছি সেতুবন্ধের গান, যে গানে
তোমার দিলখোলা সুরও লাগছে।
(বাইবেলের কালো অক্ষরগুলো)

২.
স্বাধীনতা তুমি
রবিঠাকুরের অজর কবিতা, অবিনাশী গান।
স্বাধীনতা তুমি
কাজী নজরুল ঝাঁকড়া চুলের বাবরি দোলানো
মহান পুরুষ, সৃষ্টিসুখের উল্লাসে কাঁপা—
স্বাধীনতা তুমি
শহীদ মিনারে অমর একুশে ফেব্রুয়ারির উজ্জ্বল সভা
(স্বাধীনতা তুমি)

৩.
গুচ্ছ গুচ্ছ রক্তকরবীর মতো কিংবা সূর্যাস্তের
জ্বলন্ত মেঘের মতো আসাদের শার্ট
উড়ছে হাওয়ায় নীলিমায়।

বোন তার ভায়ের অম্লান শার্টে দিয়েছে লাগিয়ে
নক্ষত্রের মতো কিছু বোতাম কখনো
হৃদয়ের সোনালী তন্তুর সূক্ষতায়
বর্ষীয়সী জননী সে-শার্ট
উঠোনের রৌদ্র দিয়েছেন মেলে কতদিন স্নেহের বিন্যাসে।
(আসাদের শাট)
উদ্ধৃত কবিতাংশগুলোর বেশির ভাগই উপমা-আশ্রয়ী চিত্রকল্পে রচিত। প্রথম উদাহরণটি উক্তিপ্রধান পঙক্তিসমবায়ে রচিত। দ্বিতীয় উদাহরণে স্বাধীনতাকে নানা কৌণিকে বিচার করার ছলে নির্মাণ করা হয়েছে দৃশ্য ও শ্রুতিগ্রাহ্য চিত্রকল্প। অসম পর্বে, অন্ত্যমিলহীন মাত্রাবৃত্তে রচিত এই কবিতার প্রধান গুণ— এর ধ্বনিময়তা, বক্তব্যের প্রবহমানতা। ছয়মাত্রার মাত্রাবৃত্তের দীর্ঘচরণ সৃষ্টি, সে চরণকে দুই বা এরও বেশি পঙক্তিকে প্রবাহিত করে দিয়ে কবি দেখিয়েছেন, ধ্বনিময়তা ও গীতিময়তা ধরে রাখতে পারলে দীর্ঘচরণেও অরুচি জন্মে না। বরং অসমপর্বে ও অমিল পঙক্তির প্রবহমানতায় একটি প্রবল গতির সৃষ্টি হয়। সে গতি পাঠককে শুরু থেকে শেষপর্যন্ত নিয়ে যায় ক্লান্তিহীন। তৃতীয় উদাহরণে ‘আসাদের শার্ট’ উপমাসমবায়ে রচিত আস্ত একটি চিত্রকল্প। এই উপমা-আশ্রিত সম্পূর্ণ চিত্রকল্পের ভেতর ‘আসাদের শার্ট’ নিরাশ্রু রোদন ও চিৎকারশূন্য প্রতিবাদের প্রতীক হয়ে উঠেছে। এই ‘নিরাশ্রু ক্রন্দন ও চিৎকার বিবর্জিত’ প্রতীক সৃষ্টিতে শামসুর রাহমান বিশেষ দক্ষতা দেখিয়েছেন।

অক্ষরবৃত্তে দীর্ঘ চরণ রচনা করেছেন জীবনানন্দ দাশ। তাঁর এক চরণ একাধিক পঙক্তিতে গড়িয়ে পড়েনি। শামসুর রাহমানও দীর্ঘ রচনা করেছেন। তবে, তাঁর এ নিরীক্ষা চলেছে অক্ষরবৃত্ত নয়, মাত্রাবৃত্ত ও স্বরবৃত্তে। এমন দুটি উদাহরণ হলো, ‘প্রেমের কবিতা’ ও ‘ইলেকট্রার গান’।
যখন তোমার সঙ্গে আমার হলো দেখা
লেকের ধারে সঙ্গোপনে,
বিশ্বে তখন মন্দা ভীষণ, রাজায় রাজায়
চলছে লড়াই উলুর বনে।

যখন তোমার পায়রা-হাতে হাতটা রেখে
ডুবে থাকি স্বর্গসুখে,
তখন কোনো গোলটেবিলে দাবার ছকে
শ্বেত পায়রাটা মরছে ধুঁকে।

আমরা যখন ঘড়ির দুটো কাঁটার মতো
মিলি রাতের গভীর যামে,
তখন জানি ইতিহাসের ঘুরছে কাঁটা,
পড়ছে বোমা ভিয়েতনামে।
(প্রেমের কবিতা)
২.
শ্রাবণের মেঘ আকাশে আকাশে জটলা পাকায়
মেঘময়তায় ঘনঘন আজ একি বিদ্যুৎ জ্বলে।
মিত্র কোথাও আশেপাশে নেই, শান্তি উধাও
নির্দয় স্মৃতি মিতালি পাতায় শত করোটির সাথে।

নিহত জনক এ্যাগামেমনন, কবরে শায়িত আজ।
(ইলেকট্রার গান)
প্রথমটি স্বরবৃত্তের পাঁচপর্বে এবং দ্বিতীয়টি মাত্রাবৃত্তের সাতপর্বের। প্রথম উদাহরণে দেশীয় পটভূমিতে প্রেমের অনুষঙ্গে আন্তর্জাতিক প্রেক্ষাপট বর্ণিত। দ্বিতীয় উদাহরণে গ্রিক মিথের আশ্রয়ে দেশি রাজনৈতিক পটপরিবর্তনের চিত্র অঙ্কিত। দুটি কবিতায়ই চরণ ভেঙে দুই পঙক্তিতে চালিয়ে দেওয়া হয়েছে। কিন্তু প্রতি চরণে চারপর্ব ও শেষ পর্ব অপূর্ণ রাখার প্রথাগত নিয়ম মান্য করেননি কবি। প্রথম উদাহরণে চরণান্তে মিল রাখলেও দ্বিতীয় উদাহরণে সে মিলও বর্জন করেছেন; প্রলম্বিত চরণ সৃষ্টির চরম স্বাধীনতা ভোগ করেছেন। সৃষ্টি করেছেন বৈচিত্র্য। তবে, দ্বিতীয় দৃষ্টান্তে প্রতি স্তবকের শেষে স্পেসসমেত একটি স্বতন্ত্র চরণ-পঙক্তি রেখেছেন। যে পঙক্তি প্রতি স্তবক শেষেই একবার উচ্চারিত হয়। ওই পঙক্তি মূলত ধ্বনি মাধুর্য সৃষ্টি ছাড়া কবিতায় নতুন কোনো বার্তা এনে দেয় না। কিন্তু বারবার উচ্চারণের মাধ্যমে মূল বিষয়ের ঐক্য ধরে রাখতে ভূমিকা পালন করে। একটি চরণ এখানে বিশ্লেষণ করা যাক—
শ্রাবণের মেঘ/ আকাশে আকাশে/ জটলা পাকায়
মেঘময়তায়/ ঘনঘন আজ/ একি বিদ্যুৎ/ জ্বলে।

এখানে অবলিগ পঙক্তি বিভক্তির চিহ্ন। এখানে চরণসংখ্যা এক, পঙক্তিসংখ্যা দুই, মোট পর্ব সাত। প্রথম ছয়পর্বের মাত্রা সংখ্যা ছয় করে, শেষ পর্বের দুই। এত দীর্ঘ চরণ সৃষ্টির উদ্দেশ্য কী? সম্ভবত গ্রিক মিথের সঙ্গে দেশের স্বাধীনতার স্থপতি বঙ্গবন্ধুর হত্যাকাণ্ডের বিষাদময়তা বর্ণনা করার জন্য দ্রুত লয়ের মাত্রাবৃত্তকে কবি উপযুক্ত মনে করেননি। গাম্ভীর্য ও বিষাদের পরিবেশ ধরে রাখার জন্য জীবনানন্দ দাশের মতো অক্ষরবৃত্তের দীর্ঘ চরণ সৃষ্টি করতে পারতেন, কিন্তু তাতে গাম্ভীর্য থাকলেও গীতিময়তা থাকত না। এ কারণেই মাত্রাবৃত্তের আশ্রয় নিয়েছেন। আর এখানেই তিনি সফল।

প্রথম উদাহরণেও কবি চরণ-পঙক্তি পর্বে একই পন্থা অবলম্বন করেছেন। এই কবিতায় কোনো অপূর্ণ পর্ব নেই। একইসঙ্গে অন্ত্যমিলশূন্যতাকে গ্রহণ করা হয়নি। এখানে অন্ত্যমিলকে অপরিহার্য করে তোলা হয়েছে। পুরো কবিতাটিতে একাধিক উপমা-প্রতীকাশ্রয়ী চিত্রকল্প নির্মাণ করা হয়েছে। যেমন—
যখন তোমার/ পায়রা-হাতে/ হাতটা রেখে/
ডুবে থাকি/ স্বর্গসুখে/,
তখন কোনো/ গোলটেবিলে/ দাবার ছকে/
শ্বেত পায়রাটা/ মরছে ধুঁকে।
‘শ্বেত পায়রা’ শান্তির প্রতীক। এই প্রতীকের মৃত্যুদৃশ্য কল্পনার মধ্যদিয়ে একটি সভ্যতা ধ্বংসের চিত্রকল্প সৃষ্টি করেন কবি। আর পুরো চিত্রকল্পটি পরিষ্কার করার জন্য চরণ ভেঙে দুই পঙক্তিতে সাজানো হয়েছে।

শামসুর রাহমানের কবিতায় অতীতের ঘটনাপুঞ্জের স্মৃতির সঙ্গে উপস্থিতকালের বিভিন্ন ঘটনার সংঘর্ষে সৃষ্ট অভিঘাতের বর্ণনা রয়েছে। সে বর্ণনা মিথ-ইতিহাস-ঐতিহ্য আশ্রয়ী। তিনি সময়ের প্রধান অসুখ রাজনৈতিক সংকটকে অন্যদের চেয়ে ভিন্নতর রূপে শনাক্ত করতে পেরেছেন। আর সময়ের চিত্রও তাৎক্ষণিক এঁকেছেন। সে চিত্র আঁকতে গিয়ে কেবল ঘটনার বিবরণকে সাংবাদিক প্রতিবেদনে পর্যবসিত করেননি; করে তুলেছেন মিথ-ইতিহাস-ঐতিহ্যের মিথস্ক্রিয়ায় কবিতায়। এ কারণে শামসুর রাহমানের কবিতায় উপস্থিত কালের প্রধান সুরটি উচ্চকিত হলেও বর্ণনায় তা পেয়েছে স্নিগ্ধতা, কোমলতা। প্রেম, প্রকৃতি, দেশ, রাজনীতি, আন্তর্জাতিকতা— ইত্যাকার অনুষঙ্গে মিথস্ক্রিয়ায় তাঁর কবিতা হয়ে উঠেছে একইসঙ্গে কল্পনা-বাস্তবের যুগ্ম-স্বাক্ষর। তবে এই অর্জনও তাঁর বড় কৃতিত্ব নয়। তাঁর বড় অর্জন অন্য জায়গায়। তিনি বুঝতে পেরেছিলেন, গ্রামীণ পটভূমির সঙ্গে নাগরিক ধারার সমন্বয় সাধন আধুনিক বাংলা কবিতার বড় সংকট। দর্শনে-চিন্তায়, কল্পনায়-স্বপ্নে, বর্ণনায়-চিত্রায়ণে আঞ্চলিকতার সঙ্গে জাতীয়তার এবং দেশীয় বিষয়ের সঙ্গে আন্তর্জাতিকতার সমন্বয়ে নৈপুণ্য দেখাতে না পারলে আধুনিক কবিতা কৈশোরকালই পার হতে পারে না। শামসুর রাহমান কবিতার এই দুর্বলতা চিহ্নিত করতে পেরেছিলেন কবি জীবনের শুরুতেই। তাই তাঁর কবিতা হয়ে উঠেছে একইসঙ্গে ব্যক্তিগত ও সমষ্টিগত। নৈঃসঙ্গ, অর্থনৈতিক সংকট, সাংস্কৃতিক বৈকল্য, রাজনৈতিক দুর্বৃত্তায়ন, মনোবিকল— এ সবের মধ্যে তিনি একটি যোগসূত্র আবিষ্কার করেছেন। সেই যোগসূত্রের সফল রূপায়ণের কারণেই তাঁর কবিতা হয়ে উঠেছে বাঙালির প্রাত্যহিক ও জাতীয় জীবনের স্বপ্ন-অভিজ্ঞতা ও মনীষার স্মারক।

179 বার নিউজটি শেয়ার হয়েছে
  • ফেইসবুক শেয়ার করুন