২৮শে মার্চ, ২০২৪ খ্রিস্টাব্দ, বৃহস্পতিবার

মানুষের জীবনের প্রতিটি ধাপই সমান সুন্দর

আপডেট: জুলাই ৩১, ২০১৯

আবদুল্লাহ আবু সায়ীদ একজন শিক্ষাবিদ, সাহিত্যিক ও সংগঠক। সমালোচক এবং সাহিত্য-সম্পাদক হিসেবেও তিনি অবদান রেখেছিলেন। সম্পাদনা করেছেন কণ্ঠস্বর নামে একটি গুরুত্বপূর্ণ সাহিত্য পত্রিকা।

একজন সফল সংগঠক হিসেবে তার জীবনের শ্রেষ্ঠ কীর্তি বিশ্বসাহিত্য কেন্দ্র, যা চল্লিশ বছর ধরে বাংলাদেশে ‘আলোকিত মানুষ’ তৈরির কাজে অবদান রাখছে।

২০০৪ সালে তিনি রোমেন ম্যাগসেসে পুরস্কার লাভ করেন।

বাংলাদেশে অ-প্রাতিষ্ঠানিক শিক্ষা বিস্তারে অবদানের জন্য বাংলাদেশ সরকার তাকে ২০০৫ সালে দেশের দ্বিতীয় সর্বোচ্চ বেসামরিক সম্মাননা একুশে পদকে ভূষিত করে। প্রবন্ধে অবদানের জন্য ২০১২ সালে বাংলা একাডেমি পুরস্কার লাভ করেন। তাকে ‘মানুষ গড়ার কারিগর’ বলে অভিহিত করা হয়। ৭০-এর দশকে তিনি টিভি উপস্থাপক হিসেবে বিশেষ জনপ্রিয়তা অর্জন করেন। ১৯৩৯ সালে ২৫ জুলাই জন্ম নেয়া এই গুণী মানুষটি এ বছর ৮০ বছরে পদার্পণ করছে। জন্মদিন উপলক্ষে তার জীবন এবং সাহিত্য নিয়ে কথা হয় হাসান সাইদুলের সঙ্গে। সেই কথোপকথনের অংশবিশেষ পত্রস্থ হল।
বি.স. কেমন আছেন, আপনার শরীরের কী অবস্থা এখন?

ভালো আছি। এখন বয়স বাড়ছে। নিজের মতো করে ভালো থাকার চেষ্টা করে যাচ্ছি। আর শরীরের অবস্থা খুব ভালো বলা যাবে না। চারপাশে ডেঙ্গুজ্বরের প্রকোপ। ভয়ে আছি।

জন্মদিন এলে আপনার কেমন লাগে?

জন্মদিন মানেই তো আমার জীবন থেকে একটি বছর গেল। শিশুদের জন্য জন্মদিন খুবই আনন্দের ব্যাপার। তার একটা দিন বাড়ল। কিন্তু প্রবীণের জন্য একটা দিন কমল। কারণ সে এগিয়ে যাচ্ছে মৃত্যুর দিকে। এখন একটি দিন চলে যাওয়া মানেই আমি প্রতিদিন মৃত্যুর দিকে যাচ্ছি।

মৃত্যু সম্পর্কে আপনার ভাবনা কী?

মৃত্যু তো অনিবার্য। এটা শুধু মানুষের বেলায় নয়। যত প্রাণী আছে সব কিছুর বেলাতেই এটা অনিবার্য। এ পৃথিবী এবং সব গ্রহ নক্ষত্রেরও ধ্বংস অনিবার্য। আমিও মৃত্যুর বাইরে নই। এ নিয়ে আমি চিন্তিতও নই। আমি মনে করি মৃত্যু একটি কাক্সিক্ষত জিনিস এবং আনন্দের জিনিস। কারণ মৃত্যু তো শুধু আমার হচ্ছে না, সবারই হচ্ছে। তাই বলতে পারি, সবার যা হবে আমারও তাই হবে।

জন্মদিন এলে কোন বিষয়গুলো বেশি মনে পড়ে?

জন্মদিন নিয়ে আমার আলাদা করে কিছু মনে পড়ার বিষয় নেই। এখন অনেক দিন বের হয়েছে। আমরা কি শুধু ভ্যালেন্টাইন ডেতে বেশি প্রেম করি। বাবা দিবসে কি বাবাকে বেশি ভালোবাসি। এগুলো পুরোপুরি বাণিজ্যিক বিষয়। এ দিনগুলো উপলক্ষ করে একশ্রেণির মানুষের কিছু মুনাফা হয়। আমার কাছে জন্মদিন নিয়ে বিশেষ ভাবনার মতো কিছু নেই। আমি প্রতিদিনই বাঁচি। প্রতিদিনের কথাই চিন্তা করি।

আপনি একবার লিখেছেন- ‘ভীরু তারাই যারা মৃত্যুকে মূল্যবান মনে করে, আর সাহসীরা তার উল্টো’। জীবন তো সত্যিই মূল্যবান কিন্তু প্রকৃত অর্থে জীবন সম্পর্কে আপনার ধারণা কী?

জীবনের তো অনেক দিক আছে। আমরা যদি একজন ভীরু মানুষের দিকে তাকাই তবে আমরা কী দেখি। তার কাছেও তো জীবন অনেক মূল্যবান। ভীরু ভাববে আহা জীবন চলে যাচ্ছে বা চলে যাবে। কিন্তু একজন সাহসী লোক জীবনকে মূল্যবান ভাববে না। তার কাছে জীবন হবে স্বাভাবিক বিষয়। সে ভাববে জীবন তো চলেই যাবে একদিন।

জীবনের তো অনেক ধাপ আছে। শিশুকাল যাকে আমরা শৈশব বলি, কিশোর ও যৌবনকাল, শেষে বার্ধক্য বা প্রবীণকাল। জীবনের এ ধাপগুলো সম্পর্কে আপনার পর্যবেক্ষণ কী?

আসলে শৈশব যে কত মূল্যবান আমরা তা শেষ জীবনে এসে বুঝি। প্রায়ই বলি শৈশব কত ভালো ছিল। আবার কৈশোরের কথা বলতে গিয়ে অনেক বিষয় বলার চেষ্টা করি। যৌবনকালের বেলাও তাই বৃদ্ধকালে এসে আমরা পেছনের কথা ভাবি এবং মৃত্যুর জন্যও অপেক্ষা করি। আসলে মানুষের জীবনের প্রতিটা ধাপই সমান সুন্দর। প্রতিটি ধাপই জীবনের গুরুত্বপূর্ণ অংশ।

৭৯ বছর আপনি অতিক্রম করেছেন। দীর্ঘপথ পাড়ি দিতে অনেক শ্রম দিতে হয়েছে, কষ্ট করতে হয়েছে। আপনার চলার পথের কষ্টকর বিষয়গুলো যদি বলতেন?

আসলে আমি এমন একজন মানুষ, আমি দুঃখের কথা, বঞ্চনার কথা মোটেও মনে রাখি না। সর্বক্ষণ আমার মনে সব আনন্দের কথা জেগে ওঠে। কবে কোথায় কষ্ট করেছি। কার কাছে লাঞ্ছিত হয়েছি। কে বকেছে। এসব মনে নেই। মনে করেই বা কী লাভ। তবে ভালো মন্দ যাই হোক না কেন আমার জীবন খুব আনন্দে কেটেছে।

আপনার প্রকাশিত কাব্যগ্রন্থ মাত্র একটি। আর কবিতা লিখছেন না কেন?
কবিতা হচ্ছে জ্বলে উঠা হৃদয়ের একটি বিষয়। কবিতা মূলত যৌবনের। আমার ধারণা, যৌবনে যারা ভালো কবিতা লিখে যেতে পারেন তারাই কেবল শেষ অবধি কবিতা লিখে যান। আমার যৌবনকালে কবিতা খুব একটা লিখতাম না। যাই লিখেছি তাও খুব যে খারাপ তাও নয়। আবার খুব ভালো কবি ছিলাম তাও না।

আপনার জীবনের অতৃপ্তি বা অপ্রাপ্তি কী?

জীবনে কার না অতৃপ্তি বা অপ্রাপ্তি থাকে। আমরা সব সময় আমাদের স্বপ্নের চেয়ে ছোট। পৃথিবীর সব মানুষই প্রচণ্ড অতৃপ্তি বা অপ্রাপ্তিতে বাঁচে। আমারও কিছু কিছু জায়গায় অতৃপ্তি আছে। অপ্রাপ্তিও আছে। লেখালেখির জায়গাতে আমার অতৃপ্তি আছে। আমার ধারণা আমি লেখক হয়ে জন্মেছি। লিখতে আমি অসম্ভব আনন্দ পাই।

কিন্তু এ আনন্দ আমি পরিপূর্ণভাবে পাইনি। আর এ আনন্দ পাওয়ার চেষ্টা করলে হয়তো বিশ্বসাহিত্য কেন্দ্র বাদ দিতে হতো। এটা কি খুব তৃপ্তির ব্যাপার হতো? বিশ্বসাহিত্য কেন্দ্র করে সমাজের জন্য তো কিছু করতে পেরেছি যার জন্য হয়তো লেখালেখির ব্যাপারে অতৃপ্তি থেকে যাবে। তবে এখন আমি আবার লেখালেখি করব বলে ভাবছি।

অনেকেই মনে করেন আপনি লেখালেখিতে নয় বরং বিশ্ব সাহিত্যকেন্দ্র সৃষ্টি করে অথবা একজন বাচিক শিল্পী হিসেবে অনেক বেশি জনপ্রিয়। আপনি কি তাই মনে করেন?

মাইকেল মধুসূদন দত্ত নিঃসন্দেহে একজন বড় কবি। আমার মনে হয় বছরে শতাধিক লোকও তার বই পড়েন না। বরীন্দ্রনাথ ঠাকুরকেই বা কয়জন পড়েন? তার বই হয়তো মানুষ কেনে। ঘরে সাজিয়ে রাখে। কিন্তু কতজনে পড়ে? বড় লেখা-সেরা লেখা সম্পর্কে বুদ্ধদেব বসু বলেছেন, বড় লেখকেরা হচ্ছেন একেকজন শ্রদ্ধেয় ‘শব’।

মানুষ তাদের শ্রদ্ধা করেন, সম্মান প্রদর্শন করেন কিন্তু স্পর্শ করেন না। আবার যারা জনপ্রিয় লেখক তাদের ওপর, তাদের লেখার ওপর মানুষ হুমড়ি খেয়ে পড়েন। কিন্তু কিছু দিন পর তারাও হারিয়ে যান। যেমন আমাদের তারকারা। কিছু দিন পর দেখা যায় যে আর নেই। তবে প্রতিভা চিরকালই তারকা থাকে। সুতরাং জনপ্রিয়তা নিয়ে আমি খুব একটা চিন্তিত নই।

আপনার একটি কবিতা আছে ‘সাতাশ বছরের কবিতা’ এ কবিতায় আপনি জীবনের অনেক অধ্যায়ের কথা তুলে ধরেছেন। এবং আপনি সাতাশ বছরেরই প্রার্থনা করেছেন। এ কবিতার ব্যাখ্যা জানতে চাই?

সাতাশ বছর পীড়ার বয়স / চোখের কালো কালশিরার বয়স
সাতাশ বছর চুটিয়ে রটায়/ সোনালী শরৎ শীতরে কোঠায়

সাতাশ বছর জীবনের জ্বর/ তবুও প্রার্থনা সাতাশ বছর…

২৫ বছর হচ্ছে রক্তিম যৌবনের কাল। ২৬ ও ২৭ পূর্ণাঙ্গ যৌবনের একটি বিশেষ সময়। এটি আমি তখন উপলব্ধি করতে পেরেছি। এখন হয়তো করি না। তবুও আমি ২৭ বছরকে কবিতার মাধ্যমে প্রার্থনা করেছি। কারণ এটি জীবনের একটি গুরুত্বপূর্ণ অধ্যায় বলে আমার মনে হয়।

আপনি তো যন্ত্রণা নামে একটি কবিতা লিখেছিলেন ১৯৬৯ সালের ১৮ ফেব্রুয়ারি পাকিস্তানি সেনাবাহিনীর হাতে বাঙালিদের নির্মম হত্যার প্রতিবাদ স্বরূপ। এখন তো আমরা প্রতিনিয়ত হত্যা, গুম ও নির্যাতন দেখতে পাই কিন্তু প্রতিবাদী কোনো কবিতা দেখতে বা পড়তে পাই না…

আসলে তখন তো প্রতিবাদ ও প্রতিরোধের জন্য সবাইকে জাগানোর জন্য লেখা। চলো সবাই…। আর তখন একটি উদ্দেশ্য ছিল। আর এখন যে নৈরাশ্য দেখতে পাই এতে আমরা জাগরণের অর্থ হারিয়ে ফেলেছি। আমরা এমনভাবে ভেঙে গিয়েছি যে মনে হচ্ছে জাগরণের কোনো অর্থ নেই। হয়তো আমার শক্তি দিয়ে অথবা সবার শক্তি দিয়ে আর কিছু হবে না এ ভাবনায় আমরা হয়তো ভেঙে পড়েছি। এটি একদিনে হয়নি।

গত চল্লিশ-পঁয়তাল্লিশ বছর ধরে ধীরে ধীরে হয়েছে। আমরা স্বাধীনতার যুদ্ধে যে শক্তির বলে জেগে উঠেছিলাম সে শক্তির পতন ঘটেছে। এর অর্থ এ নয় যে আমরা শেষ হয়ে গেছি বা যাচ্ছি। নামছি তবে আরও ওঠার জন্যই। কারণ রাত্রির শেষ মুহূর্তটা কিন্তু প্রভাতের খুব কাছাকাছি। সব মিলিয়ে এটাই বলতে চাই, উত্থান ও পতনের মধ্য দিয়ে মানব জাতি এগিয়ে যাবে সামনের দিকে। আমরাও এগিয়ে যাব।

ইতিহাস থেকে জেনেছি। খুব কম সংখ্যক। মাত্র ৬ কি ৭ জন মানুষ গুলিবিদ্ধ হওয়ার ফলে ৫২ সালে গোটা জাতি জেগে উঠেছিল কিন্তু এখন অনেক মানুষ খুন হচ্ছে, গুম হচ্ছে কিন্তু জাগরণ দেখছি না…

হ্যাঁ, তখন জাগরণের সঙ্গে জাতীয় স্বপ্ন ছিল। সে জন্য গোটা জাতি জেগেছে। এখন তো প্রায়ই খুন হত্যা গুমের মতো নির্মম ঘটনা ঘটে যাচ্ছে কিন্তু জাগরণ নেই। কারণ আমাদের চারপাশে নৈরাশ্য ও হতাশা। যার সঙ্গে সামাজিকতার কোনো সম্পর্ক নেই। ফলে সবাই জাগতে পারছি না। তবে এভাবে খুব বেশি দিন চলবে না। কোনো নৈরাশ্য বেশি দিন থাকে না। যেমন ঢেউ চিরদিন প্রবাহিত হয় না। একদিন সব কিছুই ঠিক হয়ে যাবে।

কিছু পেতে হলে তার জন্য কিছু দিতে হয়, কিছু উৎসর্গও করতে হয়। এমনই বলেন আপনি। কেন বলেন?

কিছু পেতে চাইলে অবশ্যই কিছু দিতে হবে। এ নতুন কথা নয়। তবে কিছু পাওয়ার জন্য কিছু দিতে চাইলে তা কষ্টের মধ্য দিয়ে দিলে হবে না। দিতে হবে উদযাপনের মাধ্যমে। সব কাজ সবার জন্য সমান আনন্দ নিয়ে আসে না। অথচ আনন্দ না থাকলে সাধনা থাকে না খুব। জীবনের পরিপক্ব ফল পেতে হলে এর ভেতর মাধুর্য আস্বাদন করতে হয়। তা না হলে খরখরে কাঠের মতো হয়ে যাবে। উৎসর্গের আসল অর্থ আনন্দ উদ?যাপন।

সে ক্ষেত্রে কোনো কিছু উপভোগ বা উদ?যাপন করতে কী কী করা উচিত?
নিজের হৃদয়কে অনুসরণ করতে হবে। হৃদয় কী খোঁজে, কী চায় বোঝার চেষ্টা করতে হবে। মনে রাখতে হবে, মানুষের ইচ্ছা কিন্তু তার ক্রীতদাস নয়, তারও একটা সার্বভৌম সত্তা আছে। তার সার্বভৌমত্বকে সম্মান করতে হবে। টাকার জোরে কি আনন্দ কেনা যায়? তখন ওটা হয়ে যায় একটা নিখাদ নিগ্রহের নাম।

155 বার নিউজটি শেয়ার হয়েছে
  • ফেইসবুক শেয়ার করুন