২৬শে এপ্রিল, ২০২৪ খ্রিস্টাব্দ, শুক্রবার

ক্যাসিনো সাম্রাজ্যে ধস প্রশ্নের মুখে পুলিশ, ব্যবসার সঙ্গে জড়িতদে বিরুদ্ধে ব্যবস্থা-স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী

আপডেট: সেপ্টেম্বর ২০, ২০১৯

বিজয় নিউজ রিপোট।।
ক্যাসিনো থেকে নিয়মিত মোটা অঙ্কের মাসোহারা পেতেন রাজধানীর বিভিন্ন এলাকার থানার ওসি, এডিসি এবং ডিসি। মহানগর গোয়েন্দা পুলিশের (ডিবি) নামে চাঁদা তোলা হতো। এমনকি ঢাকা মহানগর পুলিশের উচ্চপদস্থ বেশ কয়েকজন কর্মকর্তা নিয়মিত ক্যাসিনো থেকে মোটা অঙ্কের টাকা নিতেন।

বিদেশ ভ্রমণে গেলে তাদের মোটা অঙ্কের বিদেশি মুদ্রা কিনে দিতে হতো। এমনকি পুলিশের প্রভাবশালী কয়েকজন কর্মকর্তা বিদেশের ব্যয়বহুল হাসপাতালে চিকিৎসা করান। পরে যার বিল মিটিয়েছেন খালেদ।

র‌্যাব ও পুলিশের ব্যাপক জেরার মুখে এসব তথ্য দিয়েছেন গ্রেফতার হওয়া যুবলীগ নেতা খালেদ। তিনি দাবি করেন, পুলিশের বাইরে আওয়ামী লীগ ও যুবলীগের বিভিন্ন পর্যায়ের প্রভাবশালী নেতার আবদার রক্ষায় তিনি কার্পণ্য করতেন না।

বিদেশে গেলে মূল্যবান মোবাইল ফোন, স্বর্ণালঙ্কার এমনকি দামি ব্র্যান্ডের মদ এনে প্রভাবশালী নেতাদের উপহার দিতেন। খালেদ আফসোস করে বলেন, যাদের জন্য তিনি এতসব করলেন তারা বিপদের দিনে তার পাশে দাঁড়াননি। সবাই মুখ ফিরিয়ে নিয়েছেন।

র‌্যাব সূত্র জানায়, প্রাথমিক জিজ্ঞাসাবাদে খালেদ মাহমুদ ভূঁইয়া অনেকের নামই বলেছেন। তবে তার সব কথা সঠিক নাও হতে পারে। খালেদের দেয়া তথ্য যাচাই করে প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা নেয়া হবে।

স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী বলেছেন, ক্যাসিনো ব্যবসার সঙ্গে যাদেরই জড়িত থাকার প্রমাণ পাওয়া যাবে তাদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেয়া হবে। এক্ষেত্রে কাউকে ছাড় দেয়া হবে না।

এদিকে ক্যাসিনো ব্যবসা নিয়ে আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর কর্মকর্তাদের নীরব ভূমিকার কঠোর সমালোচনা করে যুবলীগ চেয়ারম্যান ওমর ফারুক চৌধুরী বুধবার এক আলোচনা সভায় বলেছেন, শুধু যুবলীগ নেতাদের গ্রেফতার করলে হবে না।

যেসব এলাকায় ক্যাসিনো চলেছে সেসব থানার দায়িত্বপ্রাপ্ত পুলিশ কর্মকর্তাদেরও গ্রেফতার করতে হবে। তিনি বলেন, ‘এতদিন কি তারা বসে বসে আঙুল চুষছিলেন।’

ক্ষোভের সঙ্গে ওমর ফারুক চৌধুরী বলেন, যারা এখন গোয়েন্দা রিপোর্ট দিচ্ছেন তারা আগে কোথায় ছিলেন। তাহলে কী ধরে নেব, আগেও জানতেন কিন্তু চুপ ছিলেন। কিন্তু কেন?

এদিকে বৃহস্পতিবার যুবলীগ সভাপতির এ বক্তব্য সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে ভাইরাল হয়ে পড়ে। সেখানে অনেকে তার বক্তব্যের সঙ্গে একমত পোষণ করে বলেন, পুলিশসহ দায়িত্বপ্রাপ্ত আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর কোনো সদস্য এ ক্যাসিনো ব্যবসার দায় এড়াতে পারেন না।

তাদের বিরুদ্ধে দৃষ্টান্তমূলক ব্যবস্থা নিতে হবে। তবে রাজনীতিবিদদের এমন অধঃপতন কেন হল, সেটিও সংশ্লিষ্টদের খতিয়ে দেখতে হবে।

ক্ষুব্ধ প্রতিক্রিয়া ব্যক্ত করে সাংবাদিকদের কাছে অনেকে বলেন- পুলিশ সদর দফতর, ডিএমপি হেডকোয়ার্টার, মতিঝিল থানা এবং রাজারবাগ পুলিশ লাইনসহ আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর গুরুত্বপূর্ণ সব দফতর এক কিলোমিটারের মধ্যে এতদিন কীভাবে জমজমাট ক্যাসিনো ব্যবসা চলতে পারল- সেটিও অনেক বড় প্রশ্ন।

এর অফিসিয়াল জবাব হয় তো কোনোদিন কেউ দেবে না, কিন্তু নৈতিকতার প্রশ্নে সাধারণ জনগণ এসব মৌলিক প্রশ্নের উত্তর জানতে চান। তারা এও বলেন, যত অজুহাত ও যুক্তি দেয়া হোক না কেন, এ দায় থেকে আইনশৃঙ্খলা নিয়ন্ত্রণকারী মন্ত্রণালয়ও নিজেদের আড়াল করতে পারে না।

সূত্র বলছে, শুধু ক্যাসিনোর রমরমা ব্যবসার কারণে রাজধানীর কয়েকটি থানায় পোস্টিং পেতে পুলিশের মধ্যে রীতিমতো প্রতিযোগিতা হয়। কয়েক কোটি টাকা খরচ করে হলেও মহানগর পুলিশের অন্তত ৫টি থানায় ওসি হিসেবে পোস্টিং পেতে রাজি অনেকে।

বিশেষ করে মতিঝিল থানার ওসি পদটি সোনার খনি হিসেবে পরিচিত। কারণ ঢাকার ক্লাবপাড়া মূলত মতিঝিল থানা এলাকায় অবস্থিত। মতিঝিল এলাকার অন্তত ৮টি ক্লাবে ক্যাসিনো চলে।

এছাড়া পল্টন, কলাবাগান, তেজগাঁও, তেজগাঁও শিল্পাঞ্চল, বনানী ও উত্তরা পশ্চিম থানার অসাধু পুলিশ কর্মকর্তারা ক্যাসিনো থেকে মোটা অঙ্কের মাসোহারা পেতেন বলে অভিযোগ রয়েছে।

শুধু থানার ওসি নন এসব এলাকার আইনশৃঙ্খলা রক্ষার দায়িত্বে নিয়োজিত উচ্চপদস্থ কর্মকর্তাদের অনেকে ক্যাসিনো থেকে মাসোহারা নেন। থানা এলাকায় দায়িত্বরত বিট পুলিশ কর্মকর্তা থেকে শুরু করে সব পর্যায়ে এ টাকা ভাগাভাগি হয়।

বৃহস্পতিবার এ প্রসঙ্গে মহানগর পুলিশ কমিশনার শফিকুল ইসলাম সাংবাদিকদের বলেন, যেসব এলাকায় ক্যাসিনো চলত সেসব এলাকার দায়িত্বরত পুলিশ কর্মকর্তাদের তালিকা করা হচ্ছে।

তাদের অবশ্যই জবাবদিহিতার মধ্যে আনা হবে। র‌্যাব যেভাবে ক্যাসিনোর বিরুদ্ধে জোরালো পদক্ষেপ নিচ্ছে পুলিশকেও সেরকম কঠোর হতে হবে।

সূত্র জানায়, ক্যাসিনো সাম্রাজ্যের গডফাদারদের বিপুল অংকের অর্থসম্পদের খোঁজ শুরু হয়েছে। গোয়েন্দা অনুসন্ধানে ইতিমধ্যে চাঞ্চল্যকর তথ্য বেরিয়ে এসেছে।

জানা গেছে, দেশে নানা ধরনের ব্যবসা-বাণিজ্যের পাশাপাশি ক্যাসিনো ব্যবসার কয়েকশ’ কোটি টাকা বিদেশেও পাচার করা হয়েছে। সিঙ্গাপুর, মালিয়েশিয়া, দুবাই ও থাইল্যান্ডে শপিং সেন্টার, অ্যাপার্টমেন্ট ও দোকানপাট কিনেছেন বেশ কয়েকজন যুবলীগ নেতা।

সম্রাটের টাকা সিঙ্গাপুরে : যুবলীগ দক্ষিণের সভাপতি ইসমাইল হোসেন সম্রাট গত ১০ বছরে কয়েকশ’ কোটি টাকা কামিয়েছেন। সিঙ্গাপুরে সম্রাটের বান্ধবী চীনের নাগরিক সিন্ডি লি এসব সম্পদ দেখভাল করেন।

যুগান্তরের হাতে আসা একটি ছবিতে দেখা যায়, সিন্ডি লির জন্মদিনে বিশাল পার্টি দেন সম্রাট। ওই পার্টিতে মদের বোতলসহ একাধিক যুবলীগ নেতা উপস্থিত ছিলেন। কোটি টাকা খরচ করা হয় পার্টিতে।

অনুষ্ঠানের মধ্যমণি ছিলেন সম্রাট ও তার বান্ধবী সিন্ডি লি। অনুষ্ঠানের একপর্যায়ে যুবলীগ নেতারা ফটোসেশন করেন।

অনুষ্ঠানে উপস্থিত ছিলেন যুবলীগ নেতা আরমানুল হক আরমান, মমিনুল হক সাঈদ ওরফে সাঈদ কমিশনার, র‌্যাবের হাতে গ্রেফতার হওয়া যুবলীগ নেতা খালেদ মাহমুদ ভূঁইয়া, যুবলীগ উত্তরের নেতা সোহেল ওরফে শেখ সোহেল ও জাহাঙ্গীর কবির নানকের সাবেক এপিএস মিজানসহ আরও অনেকে।

সূত্র জানায়, সম্রাট আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর নজরদারিতে আছেন। সবুজ সংকেত পাওয়া মাত্র তাকেও গ্রেফতার করা হবে।

থাইল্যান্ড ও মালয়েশিয়ায় সম্পদ গড়েছেন খালেদ : র‌্যাবের হাতে গ্রেফতার যুবলীগ নেতা খালেদ গত ১০ বছরে অঢেল সম্পদের মালিক বনে যান। পিডব্লিউডি, রাজউক, খামারবাড়ি, বিদ্যুৎ ও রেলভবনে টেন্ডারবাজির মাধ্যমে তিনি অন্তত দেড় হাজার কোটি টাকা কামিয়েছেন।

এসব টাকার একটি বড় অংশ তিনি বিদেশে পাচার করেন। খালেদ মূলত থাইল্যান্ড ও মালয়েশিয়ায় বড় অঙ্কের অর্থ নিয়ে যান। থাইল্যান্ডের রাজধানী ব্যাংককে খালেদ একটি দুই তারকা মানের হোটেল কেনেন।

এছাড়া থাইল্যান্ডের পর্যটন শহর পাতায়ায় ৫টি বিলাসবহুল অ্যাপার্টমেন্ট কিনেছেন। এছাড়া মালয়েশিয়ায় ১১ কোটি টাকায় ফ্ল্যাট কিনে সেকেন্ড হোম করেছেন খালেদ।

সূত্র বলছে, বিভিন্ন সরকারি দফতরে চাঁদাবাজির ক্ষেত্রে খালেদের স্টাইল ছিল অভিনব। প্রথমে তার ভাই মাসুদ সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তার বাসায় মোটরসাইকেলবহরসহ গিয়ে পিস্তলের ফাঁকা গুলি ছুড়ে আতঙ্ক তৈরি করেন।

102 বার নিউজটি শেয়ার হয়েছে
  • ফেইসবুক শেয়ার করুন