২৬শে এপ্রিল, ২০২৪ খ্রিস্টাব্দ, শুক্রবার

মাছে-ভাতে বাঙালীর দক্ষিণাঞ্চলে কৃষির পর মৎস্য সেক্টরেও অভূতপূর্ব সাফল্য।।কাকড়া কুচিয়া সহ খাচায় মাছের চাষ

আপডেট: অক্টোবর ১৬, ২০১৯

নাছিম উল আলম::  খাদ্যে স্বয়ংসম্পূর্ণ দক্ষিণাঞ্চল ‘মাছে ভাতে বাঙালী’র বাস্তব উদাহরন সৃষ্টি করে মৎস্যখাতেও স্বনির্ভরতা অর্জন করেছে। গত এক দশকে দক্ষিণাঞ্চলে মাছের উৎপাদন প্রায় ৭৫% বৃদ্ধি পেয়ে এখন প্রায় সোয়া দুই লাখ টন উদ্বৃত্ত এলাকা।

এ অঞ্চলে খাদ্য উদ্বৃত্ত প্রায় ৭ লাখ টন। গত এক দশকে দেশে মাছের উৎপাদন ৫২.৭০% বাড়লেও দক্ষিণাঞ্চলে এ বৃদ্ধির হার ৭৫%। এমনকি এসময়ে দক্ষিণাঞ্চলে ইলিশের উৎপাদন বেড়েছে ১১২%। আর সারা দেশে ইলিশের ৬৬%-ই আহরিত হয় দক্ষিণাঞ্চলে। এ পরিসংখ্যান মৎস অধিদপ্তরের।

জাতিসংঘের ‘খাদ্য ও কৃষি সংস্থা-ফাও’এর ২০১৮-এর প্রতিবেদন অনুযায়ী মূক্ত ও অভ্যন্তরীন জলাশয়ে মাছ আহরনে বাংলাদেশ সারা বিশ্বে তৃতীয় স্থানে এবং বদ্ধ জলাশয়ের মাছ উৎপাদনে ৫ম স্থানে রয়েছে। দক্ষিণাঞ্চলও এক্ষেত্র যথেষ্ট গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করছে। দক্ষিণাঞ্চলের ৬টি জেলার প্রায় ২৮ হাজার হেক্টর বদ্ধ জলাশয়, ৪ লাখ ২৭ হাজার ৮৪২ হেক্টর উন্মুক্ত জলাশয় ছাড়াও দেড় সহ¯্রাধিক বেসরকারী মৎস্য খামার, ৫০টির মত সরকারী-বেসরকারী মৎস্য হ্যাচারী, ৯২০টি নার্সাারি খামার ছাড়াও প্রায় ৯ হাজার চিংড়ি খামার মৎস্য উৎপাদনে ব্যাপক সাফল্য অর্জন করেছে। মৎস্য বিশেষজ্ঞদের মতে, কৃষি ফসলের চেয়ে মাছে মুনাফা বেশী হওয়ায় গ্রামঞ্চলের মানুষের মৎস্য চাষে আগ্রহ বাড়ছে।

আন্তর্জাতিক পুষ্টি বিজ্ঞানীদের মতে একজন মানুষের দৈনন্দিন ৬০ গ্রাম মাছের চাহিদার বিপরীতে আমাদের দেশে তা ইতোমধ্যে ৬২.৫৮ গ্রামে উন্নীত হয়েছে। কিন্তু  দক্ষিণাঞ্চলে তা আরো বেশী। যা ইতোপূর্বে ছিল ৫৩ গ্রাম। ‘বাংলাদেশ অর্থনৈতিক সমীক্ষা-২০১৮’এর হিসেব অনুযায়ী, দেশের মোট জিডিপি’র ৩.৫৭% এবং কৃষিজ জিডিপি’র ২৫.৩০% মৎস্যখাতের অবদান। দক্ষিণাঞ্চলে এ হার আরো বেশী বলে মৎস্য অধিদপ্তরের দায়িত্বশীল সূত্র জানিয়েছে। অধিদপ্তরের মতে, দেশের মোট জনগোষ্ঠীর ১১ শতাংশেরও বেশী মানুষ মৎস্য সেক্টর থেকে প্রত্যক্ষ ও পরোক্ষভাবে জীবন-জীবিকা নির্বাহ করে থাকে। ২০১৬-১৭ সালে দেশ মাছ উৎপাদনে স্বয়ংসম্পূর্ণতা অর্জন করলেও দক্ষিণাঞ্চল আরো পাঁচ বছর আগে এখাতে স্বয়ম্ভরতা অর্জন করেছে।

তবে অব্যাহত নগরায়নের ফলে বরিশাল মহানগরী সহ দক্ষিণাঞ্চলের জেলা শহরগুলোর পুকুর, দীঘি ও খালগুলো ক্রমাগত ভরাট হয়ে যাচ্ছে। যা মৎস্য সেক্টরের জন্য একটি অশনি সংকেত বলে মনে করছেন মৎস্য বিশেষজ্ঞগন। এরপরেও বর্তমানে দক্ষিণাঞ্চলের ৬টি জেলায় প্রায় ৪ লাখ ২৭ হাজার পুুকুরও দীঘি, ৬৬৭টি বরোপীট, ৯০টি প্রবাহমান নদ-নদী, ৪৩টি বিল, একটি বাঁওড় বা মরা নদী, প্রায় দেড় হাজার খাল ও সোয়া ৬শ প্লাবন ভূমি সহ মোট জলাশয়ের পরিমান ৫৪ লাখ ৫৬ হাজার হেক্টরের মত। এসব জলাশয়ে মাছের উৎপাদন ২০০৮-০৯ সালে ২ লাখ ৯৮ হাজার টন থেকে ২০১৭-১৮ অর্থ বছরে ৫ লাখ ২৩ হাজার টনেরও বেশী বৃদ্ধি পেয়ছে।

যার মধ্যে ইলিশের উৎপাদন ছিল ৩ লাখ ২৯ হাজার ২৫ টন। এছাড়াও রুই জাতীয় মাছ প্রায় ৭৬ হাজার টন। পাঙ্গাস, শিং-মাগুর, কৈ, তেলাপিয়া এবং চিংড়ি ছাড়াও অন্যান্য মাছের উৎপাদনও ছিল ১ লাখ ১৮ হাজার ২৫০ টনের মত। এসময়ে দক্ষিণাঞ্চলের সরকারী-বেসরকারী ৫০টি হ্যাচারী ও ৯২৩টি নার্সারীতে প্রায় ২৪ হাজার কেজি রেনু ও ২৮ লাখ ১৯ হাজার মাছের পোনা উৎপাদন হয়েছে।

দক্ষিণাঞ্চলের জেলাগুলোতে প্রায় ৫ লাখ জেলে মৎস্য সেক্টরের ওপর নির্ভরশীল। যারমধ্যে মৎস অধিদপ্তরের নিবন্ধিত জেলের সংখ্যা ৩ লাখ ৫২ হাজার ৭২৪। তবে মৎস অধিদপ্তরের মতে, এ অঞ্চলে জেলে পরিবারের সংখ্যা ২ লাখ ২৮ হাজারের মত। মৎস্য অধিদপ্তরের অপর এক পরিসংখ্যানে দেশের ৮টি বিভাগের মধ্যে শুধুমাত্র বরিশাল বিভাগের ৬টি জেলাতেই প্রায় সোয়া ৩ লাখ জেলে ইলিশ আহরনে জড়িত। যার ৬৫% সার্বক্ষণিক জড়িত বলে মৎস্য অধিদপ্তর সূত্রে বলা হয়েছে।

সরকার ২০১২-১৩ অর্থ বছরকে ভিত্তি বছর হিসেবে ৭ম পঞ্চ বার্ষিক পরিকল্পনায় দেশের মৎস্য চাষি ও মৎস্যজীবীদের আয় ২০% বৃদ্ধির লক্ষ্য নির্ধারন করেছে। এ লক্ষ্যে দক্ষিণাঞ্চলেও বিভিন্ন ধরনের প্রকল্প ও কর্মসূচী গ্রহনের কথা জানান হয়েছে। বেসরকারী খাতের আরো অংশগ্রহন নিশ্চিত করার লক্ষ্যে অর্থনৈতিক ও কারিগরি সহায়তা সম্প্রসারন জরুরী বলে মনে করছে ওয়াকিবাহাল মহল।

দেশের বিভিন্ন উন্মূক্ত জলাশয়ে খাচায় মাছ চাষ কার্যক্রম জনপ্রিয়তা অর্জনের অংশ হিসেবে দক্ষিণাঞ্চলের ৬টি জেলায় প্রায় দেড় হাজার খাঁচায় মাছ চাষ করে গত বছর প্রায় ১হাজার টন বিভিন্ন ধরনের মাছ উৎপাদন হয়েছে। প্রায় ১২শ মৎস চাষী এর সুফল ভোগ করেছেন। এছাড়াও দক্ষিণাঞ্চলের বিভিন্ন জেলায় কাকড়া ও কুচিয়া চাষ সম্প্রসারনে ব্যাপক সাফল্য অর্জিত হচ্ছে। গত অর্থ বছরে এ অঞ্চলের ৫টি জেলার ১১টি উপজেলায় পুকুরে কিশোর কাকড়া চাষ, পেনে কাকড়া মোটাতাজা করন, খাঁচায় কাকড়া মোটাতাজা করন ও সামাজিক পর্যায়ে কুচিয়া চাষ-এর ২৫টি প্রদর্শনী খামার স্থাপন করা হয়েছে।

ফলে গত অর্থবছরে দক্ষিণাঞ্চলের জেলাগুলোতে প্রায় ১১০হেক্টর জমির ৭৩৫টি খামারে ৩শ টন কাকড়া উৎপাদিত হয়েছে। যা আমাদের রপ্তানি খাতকে সমৃদ্ধ করতে সহায়ক হচ্ছে। এছাড়াও গত অর্থ বছরে দক্ষিণাঞ্চলের ৮টি উপজেলার প্রায় তিন হাজার মৎসজীবী ১ হাজার টন শুটকী উৎপাদন করেছে। যার পুরোটাই ছিল রোদে শুকানোর মত লাগসই প্রযুক্তির এবং কীটনাশক মূক্ত বলে মৎস অধিদপ্তর জানিয়েছে।

তবে এসব অর্জনের পরেও দক্ষিণাঞ্চলের মৎস অধিদপ্তরের অবস্থা খুব ভাল নয়। জনবল সংকটে বরিশাল বিভাগে মৎস অধিদপ্তরের কার্যক্রম অনেকটাই মুখ থুবড়ে পড়ার উপক্রম। এ অঞ্চলের ৬টি জেলার ৪২টি উপজেলার জন্য মৎস অধিদপ্তরের যে মাত্র ১৬৭টি পদে জনবল মঞ্জুরী রয়েছে, তার অর্ধেকেরও বেশী পদ শূণ্য। সর্বশেষ হিসেব অনুযায়ী ৮৩টি পদে লোকবল থাকলেও শূণ্য পদের সংখ্যা ৮৪।

এঅঞ্চলে সিনিয়র সহকারী পরিচালকের ৭টি পদের বিপরীতে আছেন মাত্র ১জন। সহকরী পরিচালকের একমাত্র পদটিও শূণ্য। সিনিয়র উপজেলা মৎস্য কর্মকর্তার ১৮টি পদের ১২টি শূণ্য। ২৪টি উপজেলা কর্মকর্তার ৪টি পদে কোন জনবল নেই। মৎস্য সম্প্রসারন কর্মকর্তার ৬টি পদের ১টি শূন্য। মৎস সম্প্রসারন ও মান নিয়ন্ত্রন কর্মকতার ৩৬টি পদ এবং মৎস জরিপ কর্মকর্তার ৬টি পদের সবগুলোই শূন্য।

৯টি খামার ব্যবস্থাপকের বিপরীতে কর্মরত ৬জন। সহকারী মৎস কর্মকর্তার ৪২টি পদে কর্মরত আছেন ২৪ জন। শূন্য ১৪টি পদ। উপ-সহকারী প্রকৌশলীর ৪টি পদের ১টি শূন্য।

এসব বিষয়ে মৎস অধিদপ্তরের বরিশাল বিভাগীয় উপথপরিচলক এর সাথে আলাপ করা হলে তিনি বলেন, দক্ষিণাঞ্চল নদ-নদী বহুল এলাকা। এঅঞ্চলে মাছ চাষের অপার সম্ভবনা রয়েছে। আমরা চেষ্টা করছি উন্নত প্রযুক্তিতে মাছ চাষ সম্প্রসারনে।

এ লক্ষ্যে মাছ চাষে সাধারন মানুষকে আগ্রহী করে তোলা সহ সব মৎস্য চাষীকে উন্নত প্রযুক্তিতে নিয়ে আসার লক্ষ্যে আমরা কাজ করছি। অধিদপ্তরে জনবল সংকট প্রসঙ্গে তিনি বলেন, বিষয়টি সদর দপ্তর ও মন্ত্রনালয়কে নিয়মিত অবহিত করা হচ্ছে। অদুর ভবিষ্যতে হয়ত এ সংকট কাটিয়ে ওঠা যাবে বলেও জানান তিনি।

126 বার নিউজটি শেয়ার হয়েছে
  • ফেইসবুক শেয়ার করুন