৫ই জুলাই, ২০২৫ খ্রিস্টাব্দ, শনিবার

বরিশালের নদ নদীতে অবাধে শিকার হচ্ছে ইলিশের পোনা * তিন মাসেও সহায়তার চাল পায়নি ২ লাখ ৩০ হাজার ৩৮৯ জন জেলে

আপডেট: জানুয়ারি ২৫, ২০২৪

মোঃ সুরুজ আহম্মেদঃঃ বরিশালের নদ নদীতে অবাধে শিকার হচ্ছে ইলিশের পোনা। নিশেধাজ্ঞা অমান্য করে এই অঞ্চলের জেলেরা মাছ শিকার করলেও তা দেখভালে তেমন কোন নজরদারী নেই। স্থানীয় প্রশাসনের মাঠ কর্মকর্তারা মনোযোগী না থাকার সুযোগ কাজে লাগাচ্ছেন অসাধু জেলেরা। আর এই জাটকা ইলিশ প্রকাশ্যেই বিক্রি হচ্ছে বরিশালসহ দখিনের হাট বাজারসহ গ্রামের পারা মহল্লায়।
বরিশাল মৎস্য অধিদপ্তর সূত্রে জানা গেছে, দেশের সকল নদ নদীতে জাটকা (১০ ইঞ্চির কম আকৃতির ইলিশ) রক্ষায় নিষেধাজ্ঞা চলছে। এর পাশাপাশি দেশের পাঁচটি ইলিশ অভয়াশ্রমে চলছে নিষেধাজ্ঞা, ১ নভেম্বর ২০২৩ সালে শুরু হওয়া এই নিষেধাজ্ঞা শেষ হবে চলতি বছরের আগামী ৩০ জুন। এ বছর বরিশাল বিভাগে নিষেধাজ্ঞা চলাকালে (কার্ডধারী) ২ লাখ ৩০ হাজার ৩৮৯ পরিবার চাল পাবে। এসময় প্রত্যেক জেলে প্রতি মাসে ৪০ কেজি করে চাল পাবে। তবে বরিশালের কোথায় গতকাল মঙ্গরবার পর্যন্ত কোন জেলে এই বরাদ্ধের চাল পায়নি।
এর মধ্যে বরিশাল জেলায় কার্ডধারী ৪৩ হাজার ২ শত ৮৯ জন, পিরোজপুর জেলায় ১৭ হাজার ৬৮২জন, পটুয়াখালী জেলায় ৫০ হাজার ১৩৯জন, ভোলা জেলায় ৮৯ হাজার ৬০০ জেলে, বরগুনা জেলায় ২৬ হাজার ৪৮৯জন জেলে ও ঝালকাঠি জেলায় ৩ হাজার ২০০জন জেলে। বিভাগের ২ লাখ ৩০ হাজার ৩৮৯জন জেলের জন্য দুই মাসের চাল বরাদ্ধ এসেছে। যা পর্যায়ক্রমে জেলেদের মাঝে বিতরন করা হবে।
মৎস্য অধিদপ্তর প্রতিবছর রেকর্ড জাটকা উৎপাদনে দেখিয়ে ইলিশসম্পদ বৃদ্ধির কৃতিত্ব দেখাচ্ছে। কিন্ত ভরা মৌসুমে নদীতে ইলিশ পাওয়া যায়না। সংকটের কারনে কয়েক বছর যাবত ইলিশের দাম মধ্যবিত্তের নাগালের মধ্যে নেই। মৎস্য অধিপদপ্তরের অসাধু মাঠ কর্মকর্তাদের জন্য ‘জাটকা’র সুরক্ষা করতে ব্যর্থ হওয়ায় ইলিশ নিয়ে এ অবস্থার সৃষ্টি হয়েছে। আহোরন বন্ধ করতে পারলে এখনকার জাটকা আগামী মৌসুম জুলাই-সেপ্টেম্বরে ৭০০-৯০০ গ্রাম ওজনের পরিপূর্ন ইলিশসম্পদে পরিনত হতে পারতো বলে দাবী জেলে সংগঠকদের।
জাটকার উৎপাদনস্থল মেঘনা ও শাখা নদীগুলোতে আহোরনের মহোৎসব চলছে। নদীতীরে প্রতিদিন শত শত মন পাইকারী বিক্রি হয়ে দেশের বিভিন্নস্থানে বাজারজাত হচ্ছে। ৩০০ থেকে সাড়ে ৩শ টাকায় এককেজি কিনলে ১০ থেকে ১২পিস ইলিশ পাওয়া যায়। মৎস্য অধিদপ্তরের আইনে এ সাইজের ইলিশকে (লম্বায় ১০ ইঞ্চির কম) জাটকা বলা হয়। যা আহোরন, পরিবহন ও বিক্রয় দণ্ডনীয় অপরাধ। মৎস্য অধিদপ্তরের এ আইনটি কাগুজে ও মাঠ কর্মকর্তাদের বানিজ্যিক আইনে পরিনত হয়েছে বলে অভিযোগ দীর্ঘদিনের।
বরিশালের হিজলা মেহেন্দিগঞ্জের মেঘনা, কালাবদর, লতা, ভোলা ও বরিশাল সদর উপজেলার অংশের মেঘনা ও তেতুলিয়া, বরিশালের কীর্তনখোলা, বানরীপাড়া-উজিরপুরের সন্ধ্যা, মুলাদীর আড়িয়ালখাসহ এখানকার সবকটি নদীতে এখন অবাদে চলছে ইলিশের পোনা নিধন।
আর এসব মাছ বরিশাল নগরীসহ সর্বত্র বিক্রি হচ্ছে। তিন থেকে চার ইঞ্চি আকৃতির ইলিশের পোনা চাপিলা নামে বিক্রি করা হচ্ছে প্রকাশ্যে। এর সঙ্গে মৎস্য অধিদপ্তরের মাঠ কর্মকর্তা ও নৌ পুলিশের উৎকোচ বাণিজ্যেরও অভিযোগ রয়েছে। জেলেরা দাবি করছেন, দাদন ব্যবসায়ী মহাজনদের চাপের মুখে তারা নিষেধাজ্ঞা অমান্য করে ইলিশের পোনা নিধনে বাধ্য হচ্ছেন। মৎস্য অধিদপ্তর এ তথ্য স্বীকার করে জানিয়েছে, নিয়মিত অভিযান ব্যাহত থাকলেও সুযোগ সন্ধ্যানি জেলেরা নদীতে মাছ ধরতে পারে।
বরিশাল মৎস্য কর্মকর্তা বিমল চন্দ্র দাস বলেন, এ অঞ্চলের নদ-নদীতে চাপিলা খুব কম পরিমাণে পাওয়া যায়, যা ধরা পড়ছে তার মধ্যে ইলিশের পোনাই বেশি।
প্রজনন মৌসুমে মা ইলিশ সাগরের নোনা পানি ছেড়ে মিঠাপানিতে এসে ডিম ছাড়ে। যে কারনে বরিশালের মেহেন্দিগঞ্জ ও হিজলা উপজেলা এবং ভোলা জেলাসংলগ্ন মেঘনা-তেতুলিয়া হলো জাটকার খনি। বিশাল এই মেঘনার অপরপ্রান্ত হলো শরিয়তপুর ও চাঁদপুর নোয়াখালীর একাংশ। এসব জেলার মেঘনাতীরের স্থানীয় জনপ্রতিনিধি ও ক্ষমতাসীন দলের প্রভাবশালীর ইলিশঘাট মালিক। তাদের ছত্রছায়ায় হাজার হাজার জেলে প্রতিদিন মেঘনা-তেতুলিয়ায় বেপরোয়া জাটকা আহোরন করছে বলে স্থানীয় সুত্র নিশ্চিত করেছে।
মৎস্যজীবী সমিতির হিজলা উপজেলার সভাপতি জাকির হোসেন জানান, শত শত জেলে মেঘনায় জাল ফেলে জাটকা আহোরন করছেন প্রতিনিয়ত। প্রতিবারে জাল ফেলে কমপক্ষে ১০ পন (৮০ পিস) জাটকা পাচ্ছে। সেগুলো ইলিশঘাটে বিক্রি হয় আকার ভেদে প্রতিপন ৮০০ থেকে ১ হাজার ২০০ টাকা। সে হিসাবে প্রতিপিস জাটকার দাম পড়ছে ১০ থেকে ১৫ টাকা। জাকির বলেন, আগামী মৌসুম জুলাই-সেপ্টেম্বরে প্রতিটি জাটকা ৭০০-৯০০ গ্রাম ওজনের পরিপূর্ন ইলিশে পরিনত হতো। পাইকারী সর্বনিম্ন ৮০০ টাকা কেজি দরে প্রতিপিসের দাম পড়তো সাড়ে ৫শ থেকে সাড়ে ৬শ টাকা। এভাবে জাটকা নিধন করায় প্রতিবছর মৌসুমে নদীতে ইলিশ সংকটে পড়তে হয় বলে আপসোস করেন জাকির হোসেন।
মেঘনা তীরের হিজলার ধুলখোলা ইউনিয়ন মৎস্যজীবী সমিতির সভাপতি মনির মাতুব্বর বলেন, গত কয়েকবছর ভরা মৌসুমে মেঘনায় ইলিশ পাওয়া যায়না। এখন জাল ফেললেই বোঝাই করে ইলিশ উঠছে। সঙ্গে প্রচুর জাটকাও পাওয়া হচ্ছে। একটি নৌকা এক বেলা জাল ফেলে আহোরিত জাটকা ১২ থেকে ১৬ হাজার টাকায় বিক্রি করতে পারছেন। শত শত নৌকায় উৎসবমুখর পরিবেশে ইলিশের সঙ্গে জাটকা ধরছেন। একই তথ্য জানিয়ে পটুয়াখালীর গলাচিপা উপজেলার আওয়ামী মৎস্যজীবী লীগের সভাপতি ধলা মাঝি বলেন, ওই এলাকার নদী রামনাবাদ, বুড়াগৌরাঙ্গ ও তেতুলিয়া মোহনায় এ মাসে মৌসুমের চেয়ে বেশী পরিমান ইলিশ পাওয়া যাচ্ছে। তবে আহোরিত ইলিশের দুই-তৃতীয়াশই জাটকা।
সংশ্লিষ্টদের সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, মেঘনা তীরে জাটকার পাইকারী সবচেয়ে বড় মোকাম হলো মাদারীপুর উপজেলার কালকীনি উপজেলার মিয়ারহাট। এছাড়া শরিয়তপুরের ঘোষেরহাট উপজেলার রেহানউদ্দিনের মাছঘাট, পট্রিবাজার, বরিশাল ও শরীয়তপুরের সীমানায় খোকা বেপারীর মাছঘাট ছোটবড় আরও অনেক মোকাম রয়েছে। বরিশাল ও ভোলার মেঘনা, তেতুলিয়াসহ অন্যান্য শাখা নদীতে আহোরিত জাটকা ট্রলারে এনে বরিশালের বিভিন্ন মোকামে পাইকারী বিক্রি হয়। সেখান থেকে সড়ক ও নৌপথে সারাদেশে বাজারজাত হচ্ছে। পটুয়াখালী জেলাঘেষা তেতুলিয়া, আগুনমুখা নদীসহ মোহনায় নিধন করা জাটকা বিক্রি হয় গলাচিপার পানপট্রি লঞ্চঘাটসহ কমপক্ষে ১০টি পয়েন্ট এবং কলাপাড়া উপজেলার আলীপুর-মহিপুর মোকামে। হিজলা, মেহেন্দিগঞ্জ ও বরিশাল নগরীর সংলগ্ন তালতলী বাজারেও পাইকারী জাটকা বিক্রি হয়। সেখান থেকে খুচরা বিক্রেতারা কিনে ছড়িয়ে পড়েন গোটা বরিশালে।
মৎস্য অধিদপ্তরের গবেষনায় ৮০ ভাগ মা ইলিশ ডিম ছাড়ে আশ্বিনের পূর্ণিমায়। প্রজনন নিরাপদ করতে প্রতিবছর আশ্বিনের পূর্নিমার আগে ও পড়ে মোট ২২ দিন ইলিশ নিধন নিষিদ্ধ থাকে। সর্বশেষ নিষেধাজ্ঞা ছিল ১২ অক্টোবর থেকে ২ নভেম্বর। নিষেধাজ্ঞা শেষে পর্যবেক্ষনের পর চাঁদপুর ইলিশ গবেষনা ইনষ্টিটিউটের পরিচালক ড. আনিছুর রহমান জানিয়েছেন, ২২দিনে ইলিশের মুল অভয়াশ্রম পদ্মা-মেঘনায় ৫২ দশমিক ৫ ভাগ মা ইলিশ ডিম ছেড়েছে। যা আগের বছরের রেকর্ড ৫২ ভাগ অতিক্রম করেছে। ড. আনিছুর রহমান জানান, একটি মা ইলিশ ১০ থেকে ২০ লাখ ডিম ছাড়ে। তার ১০ ভাগ টিকে থাকলে ৪০ হাজার কোটি জাটকার হয়েছে। সেগুলো নিরাপদে বড় হতে পারলে বছর শেষে ইলিশ উৎপাদনের পরিমান দাড়াবে প্রায় ছয় লাখ মেট্রিক টন।
নদীকেন্দ্র চাঁদপুরের তথ্য অনুযায়ী, ২২ দিনের নিষেধাজ্ঞায় মা ইলিশের ডিম ছাড়ার পরিমান প্রতিবছর আগের বছরের চেয়ে বাড়ছে। ২০১৮ সালে ৪৭ দশমিক ৭৫ শতাংশ, ২০১৯ সালে ৪৮ দশমিক ৯২ শতাংশ, ২০২০ সালে ৫১ দশমিক ২ শতাংশ, ২০২১ সালে ৫১ দশমিক ৭ শতাংশ এবং ২০২২ সালে ৫২ শতাংশ মা ইলিশ ডিম ছেড়েছে। যে কারনে প্রতিবছরই ইলিশ উৎপাদন বেড়ে সর্বশেষ অর্থ বছরে ছিল ৫ লাখ ৬৬ মেট্রিক টন।
তবে সরকারি প্রতিষ্ঠানটির দেওয়া এ তথ্যে নিয়ে ভিন্নমতও রয়েছে। জাতীয় মৎস্যজীবী সমিতির যুগ্ন মহাসচিব ইকবাল হোসেন মাতুব্বর বলেন, যদি সত্যিই উৎপাদন বাড়তো, তাহলে বাজারে ইলিশের সরবরাহও বাড়তো। গত কয়েকবছর যাবত দেশে ইলিশ সংকট চলছে। তাছাড়া মৎস্য অধিদপ্তর যে হিসাব দেখাচ্ছে তাতে বছরে ইলিশ বৃদ্ধির হার পয়েন্ট ১৬ ভাগ। অথচ ইলিশ সংরক্ষনে সরকারের ব্যয় বাড়ছে বছরে ১০ ভাগ। সরকারের ব্যয় ও উৎপাদানের মধ্যে বিশাল ফারাক।
নিষেধাজ্ঞা অমান্য করে জাটকা নিধন প্রসঙ্গে মৎস্য অধিদপ্তরের বরিশাল বিভাগীয় উপ পরিচালক নৃপেন্দ্রনাথ বিশ্বাস বলেন, তাদের স্বল্প জনবল দিয়ে বিশাল নদী পাহড়া দেওয়া মুশকিল হয়ে পড়েছে। মেঘনায় ও শাখা নদীতে জাটকা নিধনের বিষয়টি তারা শুনেছেন। অভিযানে কিছু জাল জব্দও হয়েছে। জেলা মৎস্য কর্মকর্তা বিভিন্ন সময়ে হিজলা-মেহেন্দিগঞ্জের মেঘনা নদী পর্যবেক্ষন করছেন। তাছাড়া ১১ জানুয়ারী থেকে এই অহ্চলে কম্বিং অপারেশন চলছে। ###

71 বার নিউজটি শেয়ার হয়েছে
  • ফেইসবুক শেয়ার করুন