২৮শে মার্চ, ২০২৪ খ্রিস্টাব্দ, বৃহস্পতিবার

দেনা পাওনা

আপডেট: জানুয়ারি ২০, ২০২০

সাইফুর রহমান :: নাজিমগড়ের নবাব শাহ্ আসাফউদ্দৌলা রঙমহলে বসে বোতলের পর বোতল সুরা উদরস্ত করেও দৃষ্টি তার তীক্ষ্ণ ও টনটনে। সুরাপানে যৌবন বয়স থেকেই নবাব বেশ সাবালক। বোতলের পর বোতল শূন্য করেও স্থির থাকতে পারেন। সাধারণত তিন চারেক বোতল শেষ করে তবেই নবাবের চোখ তন্দ্রাতুর হয়। নচেৎ নয়। নবাবের আবার বিলেতি স্কচ ধাতে সয় না। দেশি চোলাই, তাড়ি, হাড়িয়া তো অনেক দুরকা বাত। নবাব পান করেন ফরাসি মদিরা। ইংরেজিতে যাকে বলে ওয়াইন। এছাড়া সিরাজীও নবাবের প্রিয়সুরা। সিরাজী আসে পারস্য থেকে। কিন্তু নাদির শাহের পারস্য অভিযানের পর সিরাজীর জোগান কমে যাওয়ায় ফরাসি সুরাই নবাবের এখন শেষ ভরসা। মাঝে মাধ্যে সেই ফরাসি সুরার জোগানও দুর্গম হয়ে ওঠে। সে জন্য নবাব মোটা মাইনে দিয়ে ফ্রান্সের দক্ষিণ অঞ্চল থেকে মঁশিয়ে শেভেলিঁয়ের নামে একজন ওয়াইন প্রস্তুতকারককে নিয়ে এসেছেন নাজিমগড়ে। সোমব্রত মাইতি নামেও নবাবের একজন সুরাবিশারদ আছেন যিনি আনার, আনারস প্রভৃতি ফলের নির্যাস থেকে হৃদয় হরণকারী অদ্ভুদ কিছু সুরা তৈরিতে সিদ্ধহস্ত। সোমব্রত ও তার পূর্ব পুরুষ কয়েক’শ বছর ধরে বিশেষ এই মদিরা তৈরি করে আসছেন। বিশেষ বিশেষ পালাপার্বণে নবাব সাধারণত এ সুরা পান করেন। আসাফউদ্দৌলা একবার সোমব্রত মাইতিকে জিজ্ঞেস করলেন- আচ্ছা সোমব্রত ধর হঠাৎ তোমার যদি মৃত্যু ঘটে তাহলে তোমার এই সুরা তৈরির গুপ্ত কৌশল তো গুপ্তই থেকে যাবে। এ বিদ্যা তুমি বরং কাউকে শেখালে ভালো হতো না। সোমব্রত রহস্য সূচক হাসি হেসে বলল- ওটা আমি শুধু আমার পুত্রকেই শেখাব জাহাঁপনা। এটাই আমাদের বংশের রীতি। নবাব বললেন- তোমার ছেলে তো এখনও নাবালক। কিন্তু তার আগেই যদি…।

আচ্ছা সোমব্রত তোমার পূর্ব পুরুষ কীভাবে সন্ধান পেয়েছিল এই সূত্রের। সোমব্রত স্মিত হেসে বললেন- অধিরাজ, সে আমি সঠিক করে বলতে পারব না। তবে আমরা সনাতন ধর্মের মানুষ। এ তো আমাদের রক্তেই মিশে আছে। আপনি কি জানেন না, বৈদিক ব্রাহ্মণরা সাতভাগে সোমযজ্ঞ উদ্যাপনের সময় সোমরসের আহুতি দিতেন। সোমরস নিষ্কাশন পদ্ধতিকে বলা হতো ‘সোমাভিষধ’। বিভিন্ন উদ্ভিজ উত্তেজক ও ফলের রস মিশিয়ে তৈরি হতো সে যুগের মদ। ঋগে¦দে তো একটা গোটা সূত্রই আছে সোমরসের মহিমায়।

নবাব ঈষৎ কণ্ঠ চড়িয়ে নর্তকিকে উদ্দেশ করে বললেন- থামো থামো, দয়া করে বন্ধ করো এই নৃত্য। কি নাম তোমার বৎস্যে?

-গুলবদন, জাহাঁপনা।

-নবাবের মুখে বঙ্কিম হাসি, গুলবদন? গুলবদন!! নবাবের মুখে নামটি বেশ ক’বার আওড়াতে দেখে নর্তকি বিস্ময়াবিভূত কণ্ঠে জিজ্ঞেস করলেন- চমকে উঠলেন যে জাহাঁপনা। গুলবদন নামে কাউকে কি চেনেন? নবাব বললেন- চিনি তো বটেই। কিন্তু ভাবছি সময়ের এ কেমন নির্মম পরিহাস। সম্রাট বাবরের এক কন্যা ছিল গুলবদন নামে। ওই যে বিখ্যাত হুমায়ুননামা বইটির লেখিকা। এই উপমহাদেশে গুলবদনই প্রথম নারী যে মক্কা থেকে হজ করে এসেছিলেন। গুলবদন ছিলেন ধর্মপরায়ণ ও পরহেজগার মহিলা। অথচ আজ গুলবদন নামে যে মেয়েটি আমার সামনে দাঁড়িয়ে আছে সে একজন নাচনেওয়ালি। গুলবদন বললেন- গুস্তাকি মাফ করবেন জাহাঁপনা। গরিবের ঘরে জন্মেছি বলেই হয়তো বাইজিগিরি করে জীবন চালাতে হচ্ছে। ধনীর ঘরে জন্মালে ভাগ্য হয়তো ভিন্নরকম হতো।

করুণার মৃদু হাসি হেসে নবাব বললেন- গুলবদন তুমি কি কখনও সরোবর দেখেছ।

-জি জাহাঁপনা দেখেছি।

-তেষ্টা মেটাতে জন্তুজানোয়ার যখন জলাশয়ে ঝাঁপিয়ে পড়ে তখন তাদের খুরের আঘাতে পানির নিচ থেকে উঠে আসা ময়লা ও কাদামাটির পাঁক-পঙ্কিলতা উপেক্ষা করে- সফেদ শুভ্র শ্বেতকমল কিন্তু ঠিকই মাথা উঁচু করে ফুটে থাকে পানির ওপরে। এক ফোঁটা ময়লা, কাদামাটি, পাঁক-পঙ্কিলতার কিছুই তাকে স্পর্শ করতে পারে না। দুনিয়াতে নিজের ইচ্ছার ওপরই সবকিছু নির্ভর করে গুলবদন।

সে যাক, তুমি এতক্ষণ কি নাচ নাচছিলে? নর্তকি সম্ভ্রমের সঙ্গে উত্তর দিলেন- জাহাঁপনা ওটা ওড়িশি নৃত্য। পেয়ালায় চুমুক দিতে দিতে নবাব বললেন- তুমি কি কত্থক জান? গুলবদন বললেন- জি জাহাঁপনা। তাহলে এবার কত্থক শুরু হোক। এসব ওড়িশি নাচে আমার পোষাবে না। ভরতনাট্যম, কথাকলি, কত্থক এগুলো হলো নৃত্য, বাকি সবই তো অর্বাচীন। নবাবের চোখে অন্যসব নৃত্য যে অর্বাচীন হবে সেটাই স্বাভাবিক। তিনি একজন শৌখিন শায়ের, নিজে কবিতা লেখেন এবং সে কবিতা দরবারে উপস্থিত মাননীয়-গণনীয়দের পড়ে শোনান। নবাবের কবিতা পাঠ! সে এক মজার দৃশ্য বটে। তাছাড়া খৈয়াম, হাফিজ কিংবা গালিবের অনেক কবিতা নবাবের ওষ্ঠাগ্রে বিচরণ করে সবসময়। সময় সুযোগ পেলেই উপস্থিত সকলকে শুনিয়ে দেন দু’ছত্র। ধ্রুপদি নাচ ছাড়া অন্য নৃত্যে যে তার হৃদয় পরিশ্রুত হবে না সেটাই তো স্বাভাবিক। নর্তকির সঙ্গে কথা বলতে বলতে তিনি পুনরায় ঠোঁট ছোঁয়ালেন পেয়ালায়। নবাবের প্রধান উজির, উজিরে আযম, আমীর মোহাম্মদ উৎকণ্ঠিত কণ্ঠে বললেন- মান্যবর, আপনার মদ্যপান দিনকে দিন কিন্তু বেড়েই চলছে। বয়সে আপনি অশীতিপর। অতিরিক্ত মদ্যপানে যে কোনো সময় অসুস্থ হয়ে পড়বেন যে। তাছাড়া ধর্মের কথা বিবেচনা করেও আপনার পানভোজন থেকে দূরে থাকা উচিত। নবাব আসাফউদ্দৌলা আমীর মোহাম্মদের কথা শুনে ক্ষেপে আগুন। এ ক্যায়া বেতরিবত!!! উজিরে আযম, তুমি জানো না একমাত্র আওরঙ্গজেব ব্যতীত সকল মুঘল সম্রাট-ই সুরা পান করতেন, সে হোক কম আর বেশি। সিরাজউদ্দৌলার কথা আর না-ই-বা বললাম। তুমি নিজেও হয়তো জানো সুরাপানে তিনি কতটা আসক্ত ছিলেন। আমার রাজ্যে সাহারা যদি নাক ডুবিয়ে সুরা পান করে তবে শেখরাও যে লুকিয়ে চুকিয়ে দু-চার ঢোক গলায় ঢালে না, সে কথা কি তুমি হলফ করে বলতে পারো। তোমার কথা ভিন্ন। তুমি ধর্মপরায়ণ মানুষ। কিন্তু আমার দরবারে কয়জন মদ্যপায়ী সে বিষয়টি কিন্তু আমার অজানা নয়। আমার অসুস্থতার কথা যেহেতু বললে সে কারণেই বলছি- পারস্যের লাল মদিরা আবিষ্কার নিয়ে একটি কিংবদন্তি চালু আছে আমি তোমাকে সেটা শোনাতে চাই। আমার কাছে এসে বস। আমীর মোহাম্মদ নবাবের পাশে এসে বসলেন।

তুমি জানো কিনা জানি না আমীর, ওয়াইনের জন্ম পাঁচ হাজার বছর আগে। পারস্যের এক রাজা দিশেমসিদ জানতেন আঙুর পচিয়ে যে রস হয় তা বিষবৎ। পান করলে নিশ্চিত মৃত্যু। তার হারেমে এক বিবির মাথা ধরার রোগ ছিল। মাথার যন্ত্রণায় তিনি প্রায়ই কাতরাতেন। একবার অসহ্য যন্ত্রণায় কাতর হয়ে আত্মহত্যার অভিপ্রায়ে বিবিসাহেবা পচা আঙুরের রস পান করে ফেলেন, কিন্তু কী আশ্চর্য! মৃত্যু তো দূরের কথা, মাথাব্যথা গেল ছেড়ে, দেহমন একেবারে চাঙ্গা। এ কথা জানার পর রাজা সেই তথাকথিত বিষ পানীয়র সমাদর শুরু করে দিলেন। যা আদতে ওয়াইন ছাড়া ভিন্ন কিছু তো নয়।

সে যা হোক, এখন আমাকে নৃত্য উপভোগ করতে দাও আমীর। নবাবের আঁখি অর্ধনীমিলিত। বীণার সুললীত ঝঙ্কার সেই সঙ্গে নর্তকির নূপুরের মৃদু নিক্কনের তালে তালে নবাব কাত হয়ে কোলবালিশ বুকে জড়িয়ে হাতের আঙুলগুলো দিয়ে তার ঊরুর ওপর ঢেউ খেলানো স্পন্দন দিচ্ছিলেন। গুলবদনের নাচে নবাবের দেহমন সম্পূর্ণ মশগুল। ঠিক এমন সময় ফটকের বাইরে কিসের যেন শোরগোল শোনা গেল। নবাব বেশ বিরক্ত হলেন। দ্বারে সর্বক্ষণ সতর্ক পাহারায় আছে দৌবারিক তারপরও কেন এত হট্টগোল। তিনি চিন্তান্বিত। রুষ্ঠ। উদ্বিগ্ন। এক আমাত্যকে আদেশ করলেন- এক্ষুণি গিয়ে খোঁজ নাও বাইরে গোলমালের কি হেতু। আমাত্য খোঁজ নিয়ে এসে নবাবকে জানালেন বাইরে এক আগন্তুক নবাবের সাক্ষাৎপ্রার্থী। আমাত্য নবাবকে উদ্দেশ করে আরও বললেন- আমি বারংবার তাকে অনুরোধ করেছি রাজ্যেশ্বর, কাল দরবারে এসে আপনার সাক্ষাৎপ্রার্থী হতে কিন্তু আগন্তুক তার সিদ্ধান্তে অনড়। সে কিছুতেই আপনার সঙ্গে দেখা না করে ফিরে যাবে না। নবাবের আদেশে পরিব্রাজককে উপস্থিত করা হল রঙমহলে। নবাব আগন্তুককে উদ্দেশ করে বললেন- তোমার এত বড় দুঃসাহস আমার প্রমোদাভিসারে বিঘœ ঘটালে। আগন্তুক বললেন- হে ধর্মরাজ, হে প্রজানুরঞ্জক আমাকে মার্জনা করবেন। বাধ্য হয়েই আপনার সঙ্গে সাক্ষাৎ করতে হল। আমি একজন শিল্পী। শ্রোতাদের গান শোনানো আমার পেশা। আমি জানতে পেরেছি, নবাব একজন ভীষণ সঙ্গীত অনুরাগী। দূর-দূরান্ত থেকে শ্রুতকীর্ত সব গায়ক-গায়িকা ও সুরসম্রাটদের খুঁজে এনে গান শোনেন। আমার অভিপ্রায় এই যে গান শুনিয়ে যদি নবাবকে মুগ্ধ করতে পারি তাহলে হয়তো আমার ভাগ্যও বদলে যাবে।

নবাব সকৌতুকে আগন্তুককে জিজ্ঞেস করলেন- কী নাম তোমার বৎস? তুমি আসছ-ই বা কোত্থেকে? আগন্তুক বললেন- রাজন, আমার নাম মজনু শাহ। নিবাস, অমৃতনগর। নবাব বললেন- অমৃতনগর? সে তো বহুদূরের পথ। মজনু শাহ বললেন- জি জাহাঁপনা, আমি বহুদূর পথ অতিক্রম করেই এখানে উপস্থিত হয়েছি। নবাব হর্ষোৎফুল্ল কণ্ঠে বললেন- তথাস্তু। এতদূর পথ পাড়ি দিয়ে যখন এসেছ গান শুনিয়ে মুগ্ধ করবে, তবে শোনাও তোমার গান। বাঁশির সুরলহরি, হারমোনিয়ামের সুললীত সরগম, বীণার ঝঙ্কার, তবলার ছন্দোবদ্ধো ধ্বনি- রঙমহলের বাদ্যযন্ত্রগুলো সব একসঙ্গে তুলল সুরের মহাঐকতান। মজনু শাহ গান ধরলেন- ‘হে রাজন, তোমারই পদতলে আজ আমার এই তুচ্ছ অর্ঘ্য…।’ নবাব আসাফউদ্দৌলা জীবনে বহু শিল্পীর কণ্ঠে বহু গান শুনেছেন কিন্তু আজ তার কাছে মনে হল যেন এমন সুর, এমন দরাজ কণ্ঠ শোনার জন্যই বোধকরি তার হৃদয় বহুদিন ধরে তৃষ্ণিত ছিল। নবাবের মনে হচ্ছে তার হৃদয় মরুভূমিতে যেন কুলকুল করে বইতে শুরু করেছে সুমিষ্ট স্রোতোস্বিনী এক নদী। গান শেষ হতে না হতেই নবাব উল্লোসিত কণ্ঠে বলে উঠলেন- বহুতখুব! বহুতখুব! নবাব মজনু শাহকে উদ্দেশ করে বললেন- তুমি যেমন অমৃতনগর থেকে এসেছ ঠিক তেমনি তোমার কণ্ঠটিও যেন অমৃতলোকের। আহ্া! আমার শ্রবণইন্দ্রিয়ের যে কি সুখানুভূতি হল সেটা তোমাকে বোঝাতে পারব না। নবাব হাঁক ছাড়লেন- এই কে আছিস। এক্ষুণি গায়ককে এক চর্মপেটিকা রৌপ্যমুদ্রা প্রদান করা হোক। গায়ক পুনরায় গাইতে শুরু করলেন- অকলঙ্ক শশিমুখী/সুধাপানে সদাসুখী/তনু তনু নিরখি, অতনু চমকে…। গান শেষ হতেই নবাব বললেন- অসাধারণ গায়কি কণ্ঠ তোমার বৎস। মনপ্রাণ দুটোই জুড়িয়ে গেল। নবাব অস্ফুট কণ্ঠে বললেন- না না শুধু একচর্মপেটিকা রৌপ্যমুদ্রা যথেষ্ট নয়। নবাব যথারীতি পুনরায় হাঁক ছাড়লেন- এই কে আছিস। এই সুর সাধক কে এক্ষুণি একচর্মপেটিকা স্বর্ণমুদ্রা বক্শিশ দেয়া হোক। নবাব মজনু শাহকে উদ্দেশ করে বললেন- বৎস তোমার গান শুনে এ মুহূর্তে আমার শুধু একজনের কথাই মনে পড়ছে। যদিও তার কণ্ঠে গান শোনার সৌভাগ্য আমার হয়নি। কিন্তু তার কথা বইতে অনেক পড়েছি। মজনু শাহ অনুসন্ধিৎসু কণ্ঠে বললেন- কার কথা বলছেন জাহাঁপনা। নবাব বললেন- মিয়া তানসেন। শুনেছ কখনও তানসেনের নাম? মুঘল বাদশাহ আকবরের রাজদরবারে নবরত্নের মধ্যে অন্যতম ছিলেন তিনি। মজনু শাহ বললেন- শুনেছি জাহাঁপনা। কিন্তু তার সম্পর্কে বিশেষ কিছু জানি না। শুধু এতটুকু জানি যে, তিনি নাকি গান গেয়ে ধরণিতে বৃষ্টি নামাতে পারতেন। নবাব দীর্ঘ নিঃশ্বাস ছেড়ে বললেন- তুমি ঠিকই বলেছ মজনু। যখন আকাশে বৃষ্টির কোনো চিহ্ন মাত্র নেই তখন তার কণ্ঠে বৃষ্টি বর্ষণ হতো। শুধু বৃষ্টিই নয় তিনি গান গেয়ে বৃক্ষ ও পাথর আন্দোলিত করতে জানতেন। তিনি যখন কণ্ঠ ছেড়ে গান ধরতেন তখন বিনা অগ্নি সংযোগে প্রদীপ জ্বলে উঠত। মজনু তুমি জেনে অবাক হবে যে, তানসেন কিছুদিন একটি মন্দিরের পাশে বসে গানের চর্চা করেছিলেন। কিছুদিন পর দেখা গেল মন্দিরের দেয়াল একপাশে কাত হয়ে গেছে। স্থানীয়রা নিশ্চিতভাবে বিশ্বাস করতে লাগলেন যে তানসেনের সঙ্গীতের কারণেই নাকি মন্দিরটি একদিকে হেলে পড়ছে একটু। ভারতীয় উচ্চাঙ্গসঙ্গীতের মুল সম্রাটই হলেন ভারতের সর্বকালের সর্বশ্রেষ্ঠ সঙ্গীতজ্ঞ এই তানসেন। সে যাক, তুমি আমাকে একটা কাওয়ালি শোনাও এবার। মজনু শাহ গাইতে শুরু করলেন- তুমহারি নিগাহো মে/নিগাহো সে/অ্যায়সে মিলি…। গান শেষ হতে না হতেই নবাব বললেন- বাহ্! বেশ, বেশ। অপূর্ব গায়কি কণ্ঠ তোমার বৎস। তোমার পদরেণুতে আজ ধন্য হল এই রঙমহল। রৌপ কিংবা স্বর্ণমুদ্রা কোনোটিই তোমার এই কণ্ঠের জন্য যথেষ্ট নয়। তোমাকে একটি সম্পূর্ণ তালুক দেয়ার আদেশ দিচ্ছি। নবাব পুনরায় ঠোঁট ছোঁয়ালেন মদিরা ভর্তি পেয়ালায়। নবাবের ব্যক্তিগত ভৃত্য বান্দুল উৎকণ্ঠিত কণ্ঠে বললেন- অধিশ্বর, ইতোমধ্যে পাঁচ বোতল সুরা শেষ করে ফেলেছেন। আজ আর নেশা হবে না আপনার। শুধু শুধু অতিরিক্ত মদ্যপান করে শরীর খারাপ করবেন। আমীর মোহাম্মদও বান্দুলের সঙ্গে কণ্ঠ মিলিয়ে বললেন- জাহাঁপনা নিদেনপক্ষে শরীরটাকে রক্ষা দিন আজ। মদিরা পান থেকে দয়া করে বিরত থাকুন এবার। নবাব বললেন- বান্দুল, তোমার দায়িত্ব হচ্ছে সুরা পরিবেশন, আর নেশার দায়িত্ব আমার। তোমাদের মজার একটি গল্প শোনাই তাহলে। গল্পটি অবশ্য ওমর খৈয়ামকে নিয়ে। পারস্যের বিখ্যাত কবি ওমর খৈয়াম একদিন নিশিতে বসে কবিতা লিখছিলেন। হঠাৎ তিনি তৃষ্ণার্ত বোধ করলেন। আমীর মোহাম্মদের দিকে তাকিয়ে নবাব বললেন- জানো তো আমীর, একজন সুরাসক্তের পিপাসা মানে হচ্ছে পানভোজনের প্রবল ইচ্ছা। কিন্তু খৈয়াম মনে মনে পণ করলেন গোটা কয়েক উৎকৃষ্ট রুবাই না লেখা পর্যন্ত তিনি কিছুতেই মদিরা স্পর্শ করবেন না। গোটা কয়েক লা-জওয়াব রুবাই লেখা যখন শেষ হল তখন রাত দ্বিপ্রহর। খৈয়াম হাত বাড়ালেন তার প্রিয় সিরাজীর বোতলের দিকে। কিন্তু একি! বোতল তো শূন্য। দ্রুতপদে রাস্তায় নামলেন তিনি। শুঁড়িখানার সামনে গিয়ে হাঁক ছাড়লেন- এক বোতল সিরাজী দাও শিগগির। শুঁড়িখানার অধিকারী খৈয়ামকে দেখতে পেয়ে দ্রুতবেগে ছুটে এসে সসম্ভ্রমে দাঁড়ালেন তার সামনে। মনে মনে বললেন- ভাগ্যে আজ কী যে লেখা আছে কে জানে!

স্বয়ং প্রধানমন্ত্রী নিজাম-উল-মুলকের খাস দোস্ত খৈয়াম এসে হাজির। ভয়ার্ত কণ্ঠে দোকানদার বললেন- সিরাজী তো নেই হুজুর। তাহলে অন্য কিছু দাও- অসহিষ্ণু কণ্ঠে বললেন খৈয়াম। দোকানদার কাঁপা কাঁপা কণ্ঠে বললেন- হুজুর মার্জনা করবেন কোনো পদের মদই আর অবশিষ্ট নেই। আজ খদ্দের ছিল প্রচুর। খৈয়াম বললেন- আচ্ছা পুরো বোতল দরকার নেই, গেলাসখানিক হলেও চলবে, সে হোক যে পদেরই। মদ বিক্রেতা কাচুমাচু হয়ে বললেন- হুজুর আমার জান কোরবান। কোনো মদই নেই আজ ভাণ্ডারে। শুধু নেই আর নেই। এ ক্যায়া বেতরিবত! নেই শুনে খৈয়ামের চাহিদার আগুন তখন আকাশ ছুঁয়েছে। সুরা তেষ্টায় কাতর কবি বললেন- সবগুলো বোতলের তলানি ঝেড়ে, মিলিয়ে ঝুলিয়ে আমাকে একটা গেলাস বানিয়ে দাও ভাই। কিছু একটা না হলে আজ আমার…। শুঁড়িওয়ালা এবার হাঁটুমুড়ে বসে পড়লেন মাটিতে। দু’হাত কড়জোরে বললেন- হুজুর শুঁড়িখানার সমস্ত বোতল গেলাস ধুয়ে ফেলা হয়েছে। ওমর খৈয়াম এবার প্রচণ্ড জোরে হুঙ্কার ছেড়ে বললেন- ওরে উজবুক, আহম্মকের দল। ওই ধোয়া বোতল আর গেলাস ধুয়ে আমাকে এক গেলাস পানি দে। পানশালার মালিকের চোখ কপালে। ওদিকে ওমর খৈয়াম বললেন- ঘাবড়াও মাৎ বৎস, নেশার দায়িত্ব সম্পূর্ণ আমার।

নবাবের মুখে এমন কৌতুক শুনে রঙমহলে উপস্থিত সকলে হেসে গড়াগড়ি খাওয়ার মতো অবস্থা। মজনু শাহ বললেন- সত্যি জাহাঁপনা আপনি একজন রসরাজ-ই বটে। লা-জওয়াব আপনার রসিকতা। নবাব অসহিষ্ণু কণ্ঠে বললেন- না না আর দেরি করো না, শুরু করো তোমার সুশ্রাব্য গীত। মজনু শাহ বললেন- হুজুর আপনি যেহেতু পারস্য শিল্পরসের এত বড় একজন সমঝদার, সেই জন্য আপনাকে শেখ সাদি লিখিত একটি গীত শুনাচ্ছি। তিনি কণ্ঠ ছাড়লেন- গোনা হে মর্ন নামদে র্দসোর্মা/তোরা নাথ ক্যায় বুদে আর্মু ভেগার…। গান শেষ হতে না হতেই নবাব চিৎকার করে উঠলেন- মারহাবা! মারহাবা। কি মিষ্টি সুর, কি দরাজ কণ্ঠ। বহুদিন পর এই হৃদয় তৃপ্ত হল। মনপ্রাণ ধন্য হল আজ। আসলে আমি ভেবে দেখলাম একটা আস্ত তালুকও যথেষ্ট নয়। উজিয়ে আজম- হাঁক দিলেন নবাব। আমীর মোহাম্মদ বললেন- হুকুম জাহাঁপনা। মজনু শাহকে নাজিমগড় রাজ্যের কোনো এক অঞ্চলের জায়গিরদার করে দাও। আমীর শাহ নবাবের আদেশের কোনো প্রতিউত্তর করলেন না।

কথাগুলো বলার সময় ঠোঁট কাঁপছিল নবাবের। তন্দ্রাতুর চোখ। পাঁচ-ছ বোতল সুরা উজাড় করে নেশায় বুঁদ হয়ে আছেন নবাব।

গান বাজনা ও নৃত্য একটানা চলল রাতের শেষ প্রহর পর্যন্ত। প্রাতের দিকে অমৃতনগরের উদ্দেশে রওনা হলেন মজনু শাহ। বাড়ি ফিরে ভার্যা মেহের বানুকে খুলে বললেন সব, নবাবকে গান শুনিয়ে একরাতে কীভাবে ভাগ্যের পরিবর্তন হল সেটা সত্যি এক আশ্চর্য। মেহের বানুর যেন বিস্ময়ের সীমা নেই। ভবঘুরে নিষ্কর্মা স্বামী যে নবাবকে গান শুনিয়ে এতটা বিত্ত-বৈভব অর্জন করবেন এটা যেন তার স্বপ্নেরও অতীত। আগত সুখী ও সমৃদ্ধিময় জীবনের কথা ভেবে উৎফুল্ল হয়ে উঠলেন মেহের।

এভাবে একদিন দুদিন করে কেটে গেল বেশ কিছুদিন। কিন্তু জায়গিরদারের আদেশপত্র নিয়ে এ পর্যন্ত কারও দেখা নেই। মেহের বানুই একদিন মজনু শাহকে বললেন- স্বামী, আপনি নিজেই বরং গিয়ে নবাবের সঙ্গে দেখা করে তাকে স্মরণ করিয়ে দিন পুরস্কারের কথা। মজনু শাহ বললেন- তুমি ঠিকই বলেছ মেহের। আমি কাল-ই যাব নবাবের দরবারে।

পরদিন মজনু শাহ সাক্ষাৎ করলেন নবাবের সঙ্গে। কিন্তু কি আশ্চর্য! নবাব প্রথমে তো তাকে চিনতেই পারলেন না। বিস্তারিত পরিচয় দেয়ার পর বললেন- ওহ্ এবার চিনতে পেরেছি। তুমি তো সেই যুবক যে কিছুদিন আগে একদিন গান শুনিয়ে আমাদের মুগ্ধ করেছিলে। এবার বল কী সমাচার। আজ্ঞে জাহাঁপনা আপনি গান শুনে খুশি হয়ে পুরস্কার সরূপ আমাকে কোন এক অঞ্চলের জায়গীদার করতে চেয়েছিলেন। নবাব চোখ কপালে তুলে বললেন- কি বলছ তুমি এসব! মজনু শাহ বললেন- কেন জাহাঁপনা আপনার কি কিছুই মনে নেই। হে করুণানিধি, আপনি প্রথমে আমাকে একচর্মপেটিকা রৌপ্যমুদ্রা দিতে চাইলেন। পরে বললেন- ওটা নিতান্তই কম। তার পরিবর্তে একচর্মপেটিকা স্বর্ণমুদ্রা দিতে চাইলেন। কিছু সময় পরে বললেন না না স্বর্ণমুদ্রাও যথেষ্ট নয়। আমাকে একটা আস্ত তালুক দেয়ার প্রস্তাব করলেন। পুনরায় যখন আপনাকে গান শুনালাম আপনি এতটাই মুগ্ধ হলেন যে আমাকে নাজিমগড়ের কোন এক অঞ্চলের জায়গিরদার করতে চাইলেন। মজনু শাহ বিস্মিত হয়ে বললেন- আপনার কি এসব কিছুই মনে পড়ছে না প্রজেশ্বর। হ্যাঁ, হ্যাঁ, আমার সবকিছুই মনে আছে। কিন্তু আমি ভেবে অবাক হচ্ছি যে তুমি আমার ঠাট্টা ও রসিকতাগুলো এতটুকুও বুঝতে পারনি। তোমার-ই বা কি দোষ। তুমি তো আমার মাহফিলে আনকোরা। দেখ বাপু, এই দেনা পাওনার বিষয়টি যে এখানে কেন তুলছ বুঝতে পারছি না। সেদিন গান শুনিয়ে তুমি আমার শ্রবণইন্দ্রিয়ে সুখ দিয়েছিলে। আমি ভাবলাম আমারও তো কিছু কর্তব্য আছে। সে জন্য সোনা, রুপা, তালুক জায়গিরদার এসব বলে তোমার কর্ণযুগলকেও আমি পরিতৃপ্ত করেছিলাম মাত্র। তুমি নতুন বলে রঙমহলের হাস্যরস কিংবা কৌতুকের সঙ্গে পরিচিত নও। ভেবে নিয়েছ সত্যি সত্যি আমি তোমাকে জায়গিরদারি দিয়ে দিচ্ছি। একরাত গান শোনানোর পারিশ্রমিক যদি জায়গিরদারপ্র্রাপ্তি হয় তবে নাজিমগড়ের এক ইঞ্চি জমিও কি আর এতদিনে অবশিষ্ট থাকার কথা? কথা শুনে মজনু শাহ স্থানুবৎ ও বিস্ময়াবিভূত দৃষ্টিতে নবাবের দিকে ফ্যাল ফ্যাল করে তাকিয়ে রইলেন।

163 বার নিউজটি শেয়ার হয়েছে
  • ফেইসবুক শেয়ার করুন